হতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক, হলেন সাহিত্যিক

একদিন  রাজশাহী জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টেলিগ্রাম পেলেন, আত্রাই ঘাটে রবীন্দ্রনাথ আসছেন। কবিগুরুকে অভ্যর্থনা জানাতে ঘাটে যেতে হবে তাঁকে। তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে গেলেন নাটোর। সেখান থেকে রেলপথে আত্রা। রবীন্দ্রনাথের হাউস বোটখানা ঘাটে এসে লাগল। তাঁর হাত ধরেই কবি নামলেন। রাজশাহী সফরে দীর্ঘ রেল পথ। ট্রেনের কামরায় পথসঙ্গী পূর্ব পরিচিত যুবক ম্যাজিস্ট্রেটকে কবি জানতে চাইলেন, ‘তিনি লেখেন কিনা? উত্তরে, সঙ্গী বললেন, ‘এখনও শুরু করেননি।’ কবি তাঁকে পরামর্শ দিলেন ‘ছড়া চর্চা’ শুরু করতে।

রাজশাহী জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সেই পরামর্শ মনের খুব গভীরে সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের জন্য। একসময় সরকারী পদের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন সেই চর্চার জন্যই। পরবর্তী সময়ে বদলে দিয়েছিলেন বাংলা ছড়া সাহিত্যের সামগ্রিক ধারা।

প্রথম জীবনে হতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক, কিন্তু হলেন ম্যাজিস্ট্রেট, এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে দাঁড়ালো বাংলার উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শেষ রেনেসাঁ পুরুষ। তিনি অন্নদাশঙ্কর  রায়।

ওড়িশার রাজ্য ঢেঙ্কানালের এক শাক্ত পরিবারে অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্ম। তাঁর পিতা নিমাইচরণ রায় ও মা হেমনলিনী। তাঁর পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার কোতরং গ্রামে।  ১৯০৪ এর ১৫ মে।

অন্নদাশঙ্কর  রায় প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন ওড়িয়া ভাষায়। ষোল বছর বয়সে প্রথম প্রকাশিত হয় কবিতা। 'প্রভা' নামে একটি পত্রিকা বের করতেন ওড়িয়া ভাষায়। একাধিক ভাষা জানতেন। তার মধ্যে থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্য চর্চার ভাষা হিসেবে।

 বাংলা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, 'বাংলাই আমার রক্ত শিরায়। বাংলায় আমার স্বপ্ন। বাংলাকে ভালবাসলে বিশ্বকে ভালবাসা যায়।'

 বাংলা ও ওড়িয়া দুই ভাষাতেই সমান সহজাত দক্ষতা ছিল। সমৃদ্ধ করেছেন দুই ভাষার সাহিত্যকেই।

রবীন্দ্রনাথ এবং বুদ্ধদেব বসুর অনুরোধে ছড়া লেখা শুরু করেন। ছড়া উঠে আসতে লাগল সিরিয়াস সামাজিক বিষয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু। হতে চেয়েছিলেন সাংবাদিক, হলেন ম্যাজিস্ট্রেট, শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা মুখ। তাঁর ছড়া প্রবাদের মতো হয়ে উঠেছিল। ছেলেভুলানো, হেলাফেলার ছড়া, সহজ শব্দ আর অন্তমিলের পদ্য’ যে এমন অভিঘাত আনতে পারে তার পূর্ব নিদর্শন নেই।

অন্নদাশঙ্কর  নিজে ছড়া সম্পর্কে বলেছেন, ছড়া একপ্রকার আর্টলেস আর্ট। শিশুরা সহজে পারে, বয়স্করা সহজে পারে না। মেয়েরা সহজে পারে, পুরুষেরা পারে না। অশিক্ষিতরা সহজে পারে, শিক্ষিতরা সহজে পারে না। মূর্খেতে বুঝিতে পারে, পন্ডিতে লাগে ধন্ধ।

অন্নদাশঙ্কর  গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনজন ব্যক্তিত্বের দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী এবং টলস্টয়। এই তিন মনীষীর দর্শন তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। 

 ছাত্র অবস্থায় একবার পাটনা থেকে শান্তিনিকেতন গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন। কবিগুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ আর্ট কী দৈনন্দিনের খোরাক হতে পারে?” 

উত্তরে কবি বলেছিলেন, ‘ উচ্চতর গণিত কী সবাই বুঝতে পারে?

অন্নদাশঙ্কর  ছড়া লিখেছেন একেবারেই মাটির ভাষায়, সাধারণ মানুষ সবার জন্য।  নিখাদ কৌতুক বা  ব্যঙ্গ, শ্লেষ ছড়া হিসেবে হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের ভাষা। প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ, এবং পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ছড়া লেখায় অনুপ্রেরণা হয়েছিলেন। 

 তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো!
তার বেলা?”

কিন্তু তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর ছড়া লেখার অনুপ্রেরণা  ছিল সাধারণ মানুষ। অন্নদাশঙ্কর  নিজেই তাঁর আত্মজীবনীর একজায়গায় বলেছেন,  যারা সমাজে উপেক্ষিত, সাদামাটা তাঁদের জীবন থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। ছড়া লেখার অনুপ্রেরণা এই সব মানুষরাই। তাঁদের কাছে ছড়াকার হিসেবে তাঁর দায়।

সামরাজ্য রামরাজ্য
দেখলি একে একে
বাকী থাকে কমরাজ্য
হয়তো যাবি দেখে।

কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর চলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রায় সত্তর বছর ধরে তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, ছড়া, কবিতা, নাটক, পত্রসাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রভৃতি লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁর রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২২টি। অন্নদাশঙ্করের সাহিত্যসৃষ্টি বৈচিত্র্যপূর্ণ। অনেক লেখা ‘লীলাময় রায়’ ছদ্মনামে লেখা।  

অন্নদাশঙ্কর রায় সাহিত্য আকাদেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফেলো ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমির জন্মকাল ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি ছিলেন এর আজীবন সভাপতি ও পথিকৃৎ। সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। 

২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...