উপোষ দিয়ে সাত্ত্বিকভাবে থেকে দেবী সন্তোষীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অনিতা গুহ

বাংলা ‘লুকোচুরি’ (১৯৫৮) ছবিতে কিশোর কুমারের ডবল রোল। দুই নায়িকা, মালা সিনহা ও অনিতা গুহ। ছবিতে দুই কিশোরের কমেডি আমাদের যেমন ভালো লেগেছিল, তেমনি ভালো লেগেছিল অনিতা গুহের ব্যক্তিত্বময়-রোমান্টিক নায়িকার ভূমিকায় অসাধারণ উপস্থিতি। মূলত এই ছবিটির জন্যই অনিতা আমাদের চিত্তলোকে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন আজও। তাঁর প্রথম ছবি ‘বাঁশের কেল্লা’ এখন আর পাওয়া যায় না, সেই ছবিতে তাঁর অভিনয় কেউ মনেও রাখেননি।

ভারতবর্ষে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের যে দীর্ঘ পরম্পরা রয়েছে; তারই আদি পর্বের দৃষ্টান্ত হলেন অনিতা গুহ। ১৯৫২ সালে একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হন। এবং সেখান থেকেই ‘বাঁশের কেল্লা’ (১৯৫৩) ছবিতে তাঁর অভিনয়ের সুযোগ ঘটে। তিনি হিন্দিছবির জগতে প্রথম পা রাখেন ‘দুনিয়া গোল হ্যায়’ (১৯৫৫) ছবির মধ্য দিয়ে। কিন্তু বলিউডের মূলধারার ছবির নায়িকা হিসেবে নয়, তাঁর খ্যাতি হয়েছিল পৌরাণিক ছবির দেবীচরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। একের পর এক পৌরাণিক কাহিনিতে তিনি কখনও লক্ষ্মী, কখনো সীতা, কখনও বা মহাসতী হিসেবে দর্শকের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন।

‘দুনিয়া গোল হ্যায়’ ছবির পর প্রথম দিকে ‘ট্যাক্সিস্ট্যান্ড’, ‘সম্বন্ধ’, ‘ছুমন্তর’, ‘সংযোগ’, ‘টাঙ্গেওয়ালী’ প্রভৃতি ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করলেও তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি অনিতা। তারপর তিনি যখন বিজয় ভট্টের ‘সম্পূর্ণ রামায়ণ’ ছবিতে সীতার চরিত্রে অভিনয় করলেন; অমনি শুরু হল তাঁর জনপ্রিয়তার ধারা। দর্শকের কাছে সীতা হিসেবেই পূজা পেতে শুরু করলেন। এরপর তাঁর কাছে আসতে শুরু করল ‘পবনপুত্র হনুমান’, ‘অঙ্গুলীমাল’, ‘মহাসতী অনুসূয়া’, ‘কন কন মে ভগবান’-এর মতো ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ। এই সব ছবিতে অভিনয় করে বজায় রইল তাঁর সাফল্যের ধারা।

তবে অনিতার অভিনয়জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ছবি হল, ‘জয় সন্তোষী মা’। এই ছবিতে তিনি দেবী সন্তোষীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিতে অভিনয়ের আগে তিনি দেবী সন্তোষী সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। কিন্তু দেবী সম্পর্কে জানার পর যতদিন শ্যুটিং চলেছে তিনি নিরামিষ ভোজন করেছেন। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ ডাবের জল খেয়ে থেকেছেন। চরিত্রটি নিয়ে এমন একটা ভক্তিবহ্বল ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছেন যে, মাঝে মাঝেই তাঁর অলৌকিক-দর্শনের মতো অনুভূতি হয়েছে। এ-সবই তিনি পরবর্তীকালে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ব্যক্ত করেছেন।

‘জয় সন্তোষী মা’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৫ সালে। এই সময় মুক্তি পেয়েছিল ‘শোলে’ ও ‘দিবার’-এর মতো বড় বাজেটের ও স্টারসমৃদ্ধ ছায়াছবি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে টক্কর দিয়ে সেই সময় এই অল্প বাজেটের ছবিটি পাঁচ কোটির ব্যবসা করেছিল। ছবিটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে, অনিতার সন্তোষী-সাজের পোস্টার অনেকেই পুজো করতে শুরু করেছিলেন। মহারাষ্ট্রের গ্রামে গেলে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সন্তোষীজ্ঞানে লোকে প্রণাম পর্যন্ত করেছেন।

পৌরাণিক চরিত্রে অভিনয় করতে এসে তিনি মূল ধারার ছবির নায়িকার ভূমিকা থেকে সরে এসে চরিত্রাভিনয় করতে শুরু করেছিলেন। এভাবেই তিনি ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অনুরাগ’, ‘শরমিলী’, ‘ফিফটি ফিফটি’, ‘নাগিন’, ‘জাগির’, ‘নবরাত্রি’ প্রভৃতি ছবিতে নিজের বলিষ্ঠ অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

অনিতার ব্যক্তিগত জীবন ছিল শূন্যতাময়। অভিনেতা মনিক দত্তকে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই মানিক মারা যান। অনিতা ও মানিকের কোন সন্তান ছিল না। মানিকের স্মৃতিকে বুকে রেখে সেই সন্তানহীন জীবনের শূন্যতাকেই অনিতা বরণ করে নিয়েছিলেন, দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। দৈবীচরিত্রে অভিনয়ের তৃপ্তি ও মানিকের স্মৃতিতে সন্তানহীনতার শূন্যতা নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন সারাটাজীবন, একা একা…

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...