হতে চেয়েছিলেন চিত্রপরিচালক, হয়ে গেলেন রোমান্টিক নায়ক তথা বলিষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা। আসলে, চিত্রপরিচালকও যে আজন্ম হতে চেয়েছিলেন, তাও নয়। চাইলে চিত্রশিল্পীও হতে পারতেন। খুব ভালো আঁকার হাত ছিল। ছিলেন অসম্ভব ভালো ছাত্র। ফলে, ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই হতে পারতেন, অভিনেতা না-হয়ে। এতসব কথা যাঁর সম্পর্কে বলছি, তিনি হলেন, অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ২৮ অক্টোবর। দিল্লিতে। স্কুল শেষ করে সেখান থেকে কলকাতা এলেন। সেন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়তে। সেটা গত শতকের চারের দশকের একেবারে শেষের দিক। দিল্লিতে থাকা-কালে যোগাযোগ ছিল না, কিন্তু কলকাতায় আসতেই হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল অর্ধেন্দু মুখার্জির সঙ্গে।
অর্ধেন্দু হলেন অনিলের মামাবাড়িতুতো দাদা। মানে, অর্ধেন্দুর যেখানে বাড়ি, সেই ভাগলপুরে অনিলের মামারবাড়ি। কাছাকাছি বাড়ি। সম্পর্ক সেইসূত্রেই কাছের। ফলে, দেখা যখন হয়েই গেল, অবধারিত যাতায়াত বাড়ল। অর্ধেন্দুদা, বয়সে বাইশ বছরের বড় দাদা। অনিল যখন কলকাতায় এলেন, তখন বাংলা ছায়াছবির জগতে তিনি নামকরা চিত্রপরিচালক। 'পূর্বরাগ' ও 'সংগ্রাম' নামের বাণিজ্যসফল দুই ছবির সুবাদে। আর অর্ধেন্দুদার সুবাদেই কলেজ পড়ুয়া অনিলের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। মোড় ঘুরল এক ঘরোয়া আড্ডার সুবাদে। সেই আড্ডায় অর্ধেন্দুদা বললেন যে, বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হলে ইন্ডাস্ট্রিতে 'প্রচুর শিক্ষিত বুদ্ধিদীপ্ত ইয়াংম্যানদের আসা উচিত।' কথাটা অনিলের মনে ধরল। দাদা চিত্রপরিচালক, কাজেই তাঁরও ইচ্ছে হল চিত্রপরিচালক হবার। অর্ধেন্দুর নিজের প্রযোজনা সংস্থা রয়েছে। নাম, 'আজ প্রোডাকশন্স'। নিজের ব্যানারে নিজেই ছবির পরিচালনা করছেন অর্ধেন্দু। আর সে-সব পর পর হিট হচ্ছে। সুতরাং, শিক্ষানবিশির জন্য কারও পায়ে ধরতে ছুটতে হল না। ছবির জগতে আসার কথা বলায় দাদা হলেন দেদার খুশি! আগ বাড়িয়ে তাঁকে একেবারে নিজের সহকারী করে নিলেন। ব্যস, পানসি ছুটল বেলঘরিয়া!
পুরোদমে অনিল শিখতে লাগলেন চলচ্চিত্রের কাজ। পরবর্তীকালে 'চৌরঙ্গী' ছবি পরিচালনা করে যিনি সুবিখ্যাত হবেন, সেই পিনাকী মুখার্জি তখন অর্ধেন্দুর প্রধান সহকারী। প্রিয়ও। তো, প্রিয় সহকারী পিনাকীকে ছবি পরিচালনা করার সুযোগ দিলেন অর্ধেন্দু। নিজের প্রোডাকশনে। ছবির নাম, 'যোগবিয়োগ' (১৯৫৩)। এই ছবিতে অনিল প্রধান সহকারীপরিচালক হিসেবে তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে অভিনয়ও করে ফেললেন একটি ছোট্ট চরিত্রে। এই ছবিতেই ছায়াছবির পর্দায় তাঁর প্রথম উপস্থিতি। আসলে, সেই সময় যেমন, তেমনি আজও ছোটখাটো টুকরো চরিত্রে জুনিয়র আর্টিস্টদের মধ্যে যোগ্য কাউকে না-পাওয়া গেলে বা প্রযোজকের পয়সা বাঁচাতে সে-সব চরিত্র সহকারী পরিচালকেরাই করে দেন। অনিলের এ-কাজটিও সেভাবেই করা। তবে, কাজটি করে অনিলের ক্যামেরা ভীতি যেমন চলে গেল, ক্যামেরা বুঝতে যেমন সুবিধে হল; তেমনি বেশ মজাও পেলেন। ফলে, বন্ধুবান্ধব বা ঘনিষ্ঠ পরিচালকদের অনুরোধে টুকরো চরিত্রে শখের অভিনয় করে ফেললেন পর পর বেশ কয়েকটি ছবিতে। এদিকে দিন কাটতে লাগল, দশ-বারোটি ছবিতে সহকারীর কাজ করা হয়ে গেল; তবু তাঁর জীবনে স্বাধীন পরিচালক হবার সুযোগ এলো না। কিন্তু, মোড় এসে গেল।
১৯৫৪ সাল। কবি-সাহিত্যিক-পরিচালক বন্ধু প্রেমন্দ্র মিত্র ছবি করবেন। নাম, 'ময়লা কাগজ'। নায়ক প্রয়োজন। সুদর্শন বন্ধু অনিল থাকতে আর কাকে চাই! ব্যস, বন্ধুর অনুরোধে নায়ক হয়ে গেলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। সাবিত্রী চ্যাটার্জিকে নায়িকা করে ছবি তৈরি হল। মুক্তি পেল ১৯৫৫ সালে। এও শখের অভিনয়। তবে এই পথ ধরেই প্রথম পেশাদার অভিনেতা হিসেবে নায়কের রোল পেলেন দু'বছর পর। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি 'উল্কা'-তে। চরিত্রের নাম, সুধীর। রোমান্টিক নায়ক। ছবির সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সুঅভিনেতা অনিলের জয়ধ্বজা উড়ল, আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হল না। হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-তপন সিনহার মতো বরেণ্য পরিচালকদের প্রিয় ও পছন্দের অভিনেতা। একে একে অভিনয় করলেন 'পোস্ট মাস্টার', 'মহানগর', 'মেঘে ঢাকা তারা', 'নির্জন সৈকতে', 'অগ্নিসংস্কার', 'ঢুলি', 'লৌহকপাট', 'কালামাটি', 'সাগিনা মাহাতো', 'অযান্ত্রিক', 'কোমল গান্ধার', 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' 'বনপলাশীর পদাবলী'র মতো বিখ্যাত সব ছবিতে। উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যখন বাংলা ছবির নায়ক হিসেবে স্বর্ণযুগ বিনির্মাণ করেছেন, তখন নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায় তার শরিক হয়ে নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন। হয়ে উঠেছেন সমসময়ের কাছে এবং উত্তরকালের কাছেও সমান প্রাসঙ্গিক।
তথ্যঋণ : 'সোনার দাগ'- গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ।