সময়টা ১৯৬৯। এক ভারতীয় সেতার-বাদক এসেছেন আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে।
সুর, সঙ্গীত ওই সেতার বাদকের আত্মা জুড়ে থাকে। সেই সময় রক বা পপ মিউজিকে সেতারের বেশ প্রভাব ছিল। সঙ্গীতের সাধক ওই মানুষটির লক্ষ্যই ছিল নিজের সাধনায় সমস্ত ধরনের সুরের প্রভাব রাখা। সেই সময়ের পাশ্চাত্যের বিখ্যাত সুরকার জিমি হেন্ড্রিক্সের সঙ্গে একজোট হয়ে ওই ভারতীয় সুরকার বেশ কয়েকটি নতুন সুর সৃষ্টি করলেন। প্রকাশিত হল মিউজিক অ্যালবাম। আমেরিকায় তখন ওই ভারতীয় সুরকারের সৃষ্টি করা সুরের স্রোত বইতে লাগলো। সঙ্গীত-প্রেমী আমেরিকাবাসীদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রন। জিমি হেন্ড্রিক্স এবং ওই ভারতীয় সুরকারের সৃষ্টি করা অ্যালবাম "রোলিং স্টোন্স", "লাইট মাই ফায়ার" তখন বিশ্ব সঙ্গীতের আকাশে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছিল।
১৯৭০ সালের শেষের দিকে নিজের দেশে ফিরলেন ওই ভারতীয় সুরকার। যথারীতি শুরু করলেন সুরের সাধনা। তাঁর আঙুলের স্পর্শে সেতারের তার যেন কথা বলত। কিন্তু পাশ্চাত্যে সঙ্গীত সাধনা করে আসার পর তিনি বারবার অনুভব করছিলেন, সব সুর যেন কোথাও আলাদা, স্বতন্ত্র। ঠিক মানুষের মত। আচ্ছা, সুর যদি জুড়ে দেওয়া যায়? নতুন কিছু সৃষ্টি করার ইচ্ছে তাঁকে পেয়ে বসলো। তিনি মেলালেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে। তাঁর সৃষ্টি সুরের মাধ্যমেই জন্ম নিল ফিউশন মিউজিক। সুরের একাত্ম হয়ে ওঠার সৃষ্টি হয়েছিল আনন্দ শংকরের হাত ধরে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে কাজ করার পর ভারতে এসে সেতারের সাধনা করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেছিলেন মানুষের মত সুরেরাও জুড়ে থাকতে পারে। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সুরের সঙ্গে মিশিয়েছিলেন পাশ্চাত্য সুর। এমনই অসাধারণ সুরের জাদুকর ছিলেন আনন্দ শংকর। মৃদঙ্গম-এর সঙ্গে বীণা, গিটারের সঙ্গে সেতার, সরোদের সঙ্গে রক বা জ্যাজ মিউজিকের সংমিশ্রণ হয়েছিল প্রথমবার এই সুরসম্রাটের সৃষ্টিতে।
১৯৪২ সালের ১১ই ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের আলমোড়ায় জন্ম হয় আনন্দ শংকরের। মা অমলা শংকর ও বাবা উদয় শংকর উভয়েই নৃত্য-জগতের মানুষ হলেও সন্তানকে কোনদিনই তাঁর ইচ্ছের জগত বেছে নিতে বাধা দেননি। ছোট থেকেই সুরের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। বেনারস হিন্দু বিশ্বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় বিখ্যাত সেতার বাদক ডক্টর লালমণি মিশ্রর কাছে সেতার শেখেন। বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তাঁর উৎসাহ ছিল প্রবল। যে কোন বাদ্যযন্ত্রেই নিজের আবেগ মিশিয়ে সুরের মূর্ছনা তৈরি করতে পারতেন। আমেরিকায় থাকাকালীন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন। সুরের যে পথে তিনি এগিয়েছেন সেখানেই মুক্ত ছড়িয়েছেন। তা সে ভারতীয় সঙ্গীত হোক বা পাশ্চাত্য সুর।
তবে তাঁর মূল আগ্রহ ছিল ফিউশন সঙ্গীতে। তাই সুরের ছন্দে মিলিয়ে দিতেন অন্যরকম বাজনা। যেন পাহাড়ি ঝরনার সঙ্গে খরস্রোতা কোন নদীর মিলন। তিনি মনে করতেন দুটো মানুষ যদি ভালোবেসে পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাঁচতে পারে, দুটো ভিন্ন ধারার সুরও এভাবেই একাত্ম হতে পারে। সেই সময় সঙ্গীত জগতে এমন চিন্তা-ভাবনা ছিল বিরল। তাই তাঁর সুর করা মিউজিক অ্যালবামগুলো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সঙ্গীত জগতে। বিদেশের ক্লাবগুলোতে তাঁর এই ফিউশন মিউজিক ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। ভারতেও এই ধরনের গান তাঁর মাধ্যমেই প্রবেশ করেছিল।
আনন্দ শংকরের সৃষ্টি করা সুর যেন তাঁর অস্তিত্বকে অনুভব করাতো। লন্ডনের এক বিখ্যাত ক্লাবে তাঁর অ্যালবাম শুনে একবার এক শ্রোতা সেই ক্লাবে পৌঁছে গিয়েছিল এটা ভেবে যে ওখানে বোধহয় স্বয়ং সুরের জাদুকর এসে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁর সুর করা অ্যালবামের গান "স্ট্রিটস্ অফ ক্যালকাটা" আজও কলকাতার রাস্তার মাদকতা বাঁচিয়ে রেখেছে।