"বাড়িতে একজন প্রকান্ড পুরুষমানুষ ছিলেন। যাঁর দরাজ গলার হাঁকডাকে বাড়ি গমগম করত। ভোর থেকে রাত্তির অবধি মানুষজন আসত কেবল তাঁর ভালোবাসার টানে..."
সিংহের মতো চেহারা। রাজকীয় গোঁফ। দুধ সফেদ ধুতি পাঞ্জাবি। চেহারার আভিজাত্য নজর কেড়ে নেয়। কিন্তু স্বভাবটি ষোলআনা দিলদরিয়া। সরস্বতীর সার্থক বরপুত্র।
মানুষটির নাম নরেন্দ্র দেব। বাঙালির এক উজ্জ্বল আলোক পুরুষ। সাহিত্য এবং জীবন চর্চায়। শিখিয়েছিলেন বেড়ি ভাঙতে।
কলকাতার ঠনঠনিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত দেব বাড়িতে তাঁর জন্ম। ১৮৮৮-র ৭ জুলাই। বাবা নগেন্দ্রনাথ দেব। জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রচন্দ্র দেব ছিলেন ইয়ংবেঙ্গল ঘনিষ্ঠ। শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন ডিরোজিও সাহেবের।
পারিবারিক আবহে ছোট থেকেই ভিন্ন ভাবনার মানুষ। চরিত্রে মিশে গিয়েছিল কবিতা, বিপ্লব আর বিশ্বদর্শন।
তখন সদ্য যৌবন দাদা রাজেন দেবের ছোঁয়ায় এসে নাম লেখালেন গুপ্ত বিপ্লবী দলে। একদিকে বিদ্রোহ আর অন্যদিকে বীণাপানির টান। সাহিত্যই হয়ে উঠল তাঁর আগামী।
কলেজের ধরাবাঁধা ক্লাসের পড়ায় বড় বাধা হয়ে উঠেছিল শরীর। কিন্তু তাই যেন শাপে বর হয়ে উঠেছিল। আগলহীন পাঠে বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন মেধায়-প্রজ্ঞায়।
কবিতা লিখতেন। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হল ব্রহ্মবান্ধবের একটি সান্ধ্য পত্রিকায়। ক্রমে ক্রমে মেধাবী সাহিত্যে এক মহীরুহ হয়ে উঠলেন। ভারতী, কল্লোল, কৃত্তিবাস তিন গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেই সূত্রেই সাহিত্যের নক্ষত্র পুরুষদের স্নেহের পাত্র। রাধারানী দেবীর সঙ্গে বিবাহে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র দুই বটবৃক্ষের আশীষ পেয়েছিলেন।
সংস্কারমুক্ত, উদারচেতা চরিত্রের মানুষ। অক্ষর সাধনায় মগ্ন। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য সবেতেই অবাধ। কিন্তু তাঁর নিজের কাছে তাঁর প্রথম আর শেষ পরিচয়, তিনি কবি।
রবীন্দ্রনাথের পর ভারতী পত্রিকার কার্য নির্বাহের অনেকখানি ভার তাঁর ওপর এসে পড়ে।
চলচ্চিত্র নিয়ে সিরিয়াস চর্চা শুরু করেছিলেন তিনিই। 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় 'সিনেমা ছায়ার মায়ার বিচিত্র রহস্য' শীর্ষক কলম লিখেছিলেন। টানা দু'বছর ধরে প্রকাশিত হয় সেই কলম। পরে বই আকারে প্রকাশ পায়। বইটির নাম 'সিনেমা'।
সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বইটি ছিল চলচ্চিত্র চর্চার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র, সেই সঙ্গে বাংলা ছবির অবস্থান বইয়ের বিষয়।
সিনেমা শিল্পে ব্যবহৃত বহু টেকনিক্যাল শব্দের বাংলা পরিভাষা করেছিলেন তিনি। সেই সব শব্দ সেভাবে ব্যবহার না হলেও তাতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতটুকু কমে না।
সত্যজিৎ রায়ও এই বইয়ের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম বলে মন্তব্য করেছিলেন।
সারা জীবন ধরে অজস্র সোনা ফলিয়েছেন। তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কাজ পার্শি কবি-দার্শনিক ওমর খৈয়ামের পদের বঙ্গানুবাদ। অপরটি কালিদাসের মেঘদূতের বাংলা। বিদেশি সাহিত্য এবং মাতৃভাষার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধনের কাজ করেছিলেন।
যদিও তাঁর কাজের মূল্যায়ন আজও যথাযথভাবে হয়নি।
লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন 'পিইএন'-এর ভারতীয় দায়িত্বে ছিলেন। বহু দেশ যেতে হয়েছিল সেই সূত্রে। তাঁর খাতা ভরে উঠেছিল বেড়ানোর গল্পে। পুষ্ট হয়েছিল বাংলা ভ্রমণ সাহিত্য।