১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। দেশ জুড়ে ছুটির মেজাজ। দিনটা যে শুক্রবার। ছবি রিলিজের দিন। কিন্তু আগের রাত থেকে চোখে ঘুম নেই সিপ্পি ফিল্মের ইউনিটের। ছবির নাম ‘শোলে’।
রিলিজের পরেই ছবিটিকে একটি ‘বি গ্রেডেড ফ্লপ স্টান্ট মুভি’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চূড়ান্ত নেগেটিভ সমালোচনা। অবস্থা এমনই যে পরিচালক রমেশ সিপ্পি ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাকিরা শকড!
সমালোচকদের আলোচনা থেকে বাদ পড়লেন না ছবির নবাগত অভিনেতা। আগেই ডেবিউ ফিল্ম ফ্লপ। আর সদ্য রিলিজ হওয়া শোলে’তে তাঁর পারফরম্যান্স নিয়েও মজা করতে ছাড়লেন না সমালোচকরা। আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গিয়েছিল। এই ছবিতে সে এসেছিল শত্রুঘ্ন সিনহা আর ড্যানির জায়গায়। তাঁরা রাজী হননি বলেই নবাগত অভিনেতাটি সুযোগ পেয়েছিল এই ছবিতে অভিনয়ের।
তিন দিন পর যেন ছবিটা বদলাতে শুরু করল। মুখে মুখে ছড়াতে শুরু করল শোলে। বাকিটা ইতিহাস। মুম্বই-এর মিনার্ভা থিয়েটারে টানা পঞ্চাশ সপ্তাহ চলেছিল। হিন্দি সিনেমার গ্রেটেস্ট ব্লকবাস্টার মুভি!
সঞ্জীব কুমার, অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, জয়া ভাদুড়ির মতো হেভিওয়েট অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সঙ্গে রাতারাতি উঠে এল আরও একটা নাম। নবাগত অভিনেতা মানুষের মনে তখন ‘হিরো’র জায়গায়। অভিনেতার নাম আমজাদ খান।
ভারতীয় সিনেমার দর্শকরা আর কোনও ‘ভিলেন’কে এত ভালোবাসেনি।
জংলা রঙের পোশাক। হাতে বন্দুক। কথার আগে গুলি ছোটে। কথার ফাঁকে ফাঁকে থুথু ফেলার বদঅভ্যাস। চোখে উপেক্ষার নজর। গোটা দুনিয়াকে নিজের পায়ের তলায় আনতে চায় সে। হাড়হিম হয়ে যায় পর্দায় তার হিংস্রতা দেখলে।
এমন ভয়ঙ্কর ভিলেন আগে কখনও দেখেনি দর্শকরা। তার গলার আওয়াজ, অভিব্যাক্তি, হাসি বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল দর্শকদের। শুধু মাত্র রামগড় নয়, গোটা দেশের যেন ধুকপুকুনি বেড়ে যেত পর্দায় তার গলার শব্দে। ‘শো যা, নেহি তো গব্বর আ জায়ে গা।’ পর্দার গব্বর সাধারনের ঘরেও যেন হানা দিল। গব্বর আসার ভয়ে ঘুম নেমে আসত শিশুদের চোখে।
তাঁর ‘ভয়েজ’ শুনে অবশ্য বাতিল করে দিচ্ছিলেন ছবির চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার। সেলিম জাভেদ মনে করেছিলেন ‘গব্বর’ হওয়ার মতো কাজের অভিজ্ঞতা নেই নতুন ছেলেটির।তবু থেকে গিয়েছিলেন।
নাটকের মঞ্চ থেকে তাঁকে নির্বাচন করেছিলেন রমেশ সিপ্পি। মঞ্চে নাটক করতেন আমজাদ। ছোট থেকে বাড়িতে অভিনয়ের পরিবেশ। বাবা জাকারিয়া খান হিন্দি ছবিতে অভিনয় করতেন। দর্শকরা তাঁকে চিনত অবশ্য ‘জয়ন্ত’ নামে।
একদম ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে চলে যেতেন স্টুডিও পাড়ায়। এগারো বছর বয়সে তাঁকে দেখা গেল ‘নাজনিন’ ছবিতে। শিশু শিল্পীর ভূমিকায়। ১৯৪০ সালে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক পশতুন পরিবারে জন্ম।
‘শোলে’ পরবর্তী বছরগুলোতে ফরমুলা-ওয়ান কারের মতো দৌড়ল কেরিয়ার। বোধহয় এমন কোন সিনেমা ছিল না যেখানে ক্রেডিট টাইটেলে তাঁর নাম দেখা যেত না। পারিশ্রমিকের দিক থেকেও তিনি ছিলেন প্রথম সারির অভিনেতা।
কিন্তু একটা ঘটনা আচমকাই বদলে দিল তাঁর জীবন। হিন্দি সিনেমার জগতে ‘গব্বর’- এর প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন ‘শোলে’র জয়। অমিতাভ বচ্চন। ‘দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার’ সিনেমার আউটডোর শুটিং চলছিল গোয়াতে। একদিন সন্ধেয় অমিতাভ আর আমজাদ ড্রাইভে বেরলেন স্টিয়ারিং-এ আমজাদ। হঠাৎ মাঝরাস্তায় নিয়ন্ত্রণ হারালো আমজাদের গাড়ি। অমিতাভের তেমন কিছু না হলেও বুকে বড় আঘাত পেলেন আমজাদ। গুরুতর আহত, সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তানবকে নিয়ে যাওয়া হল গোয়া মেডিকেল কলেজে। রোগীর অবস্থা দেখে গোয়ার চিকিৎসকরা আশা দিতে পারলেন না। ১৩ টা হাড় ভেঙে গিয়েছে। মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ ফুসফুস। নিয়ে আসা হল মুম্বই। নানাবতী হসপিটালে কোমায়। প্রায় ছ’মাস এভাবে চলল।
তাঁর পর্দায় ফেরার আসা কার্যত ছেড়ে দিয়েছিল সিনেমা জগত। কিন্তু লড়াইটা রক্তে নিয়ে জন্মেছিলেন। তাই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পারলেন। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের কারণে তাঁর ওজন অত্যাধিক বেড়ে যায়।
অসুস্থতার কারণে অনেক সিনেমা থেকে বাদ পড়তে হয়। গ্ল্যামার, আলোর যে ছবিটা তাঁর চেনা ছিল সেইসবও যেন পালটে গিয়েছে। কিন্তু একজন পরিচালক তখনও তাঁর ওপর বাজি ধরতে রাজী ছিলেন। ভরসা রেখেছিলেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা অভিনেতার ওপর। তাঁর ওজন, বদলে যাওয়া চেহারা কোনও কিছুই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।
সত্যজিৎ রায়। তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে। অভিনেতা বাছাইয়ে সত্যজিত্ ছিলেন নির্ভুল। রাজপাট হারানো আওয়াধ এর শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের রিরকে যথার্থভাবে বের করে এনেছিলেন আমজাদের ভিতর থেকে। সালটা ১৯৭৭।
প্রায় কুড়ি বছরের কেরিয়ারে তিনি ১৩০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন।
বাড়তি ওজন ক্রমশ সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল অভিনেতার জন্য। ব্যক্তিগত জীবনে নিপাট ভদ্রলোক মানুষটি খেতে ভালবাসতেন। মিষ্টি খেতে অসম্ভব ভালোবাসতেন। আর চা। একজন নিত্য সঙ্গী ছিল তাঁর যার কাজ ছিল সারাদিন তাঁকে শুধু চা করে দেওয়া।
সেই ওজনই শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ এক ভোরে মুম্বই শহর জানতে পারল গব্বর আর নেই। আচমকাই থামিয়ে দিয়েছেন পথ চলা।
শুধু ‘গব্বর’ নয়, বহু সিনেমাতে তাঁর অভিনয় দক্ষতার হীরে মুক্তো আজও নজর কাড়ে দর্শকদের। আমজাদ একআর বলেছিলেন, “পরিচালকরা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আমাকে কমিক রোল দিয়েছিলেন আবার ইমোশনাল চরিত্রেও দেখা গিয়েছে। টাইপ কাস্ট হওয়ার হাত থেকে ওঁরাই আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। দর্শকরা যখন আমার ছবি দেখত্তে আসে তাঁরা আন্দাজ করতে পারে না আমাকে কীভাবে দেখবে। অনেকটা চন্দ্রশেখরের গুগলির মতো।” তাঁর জন্য এটাই সারসত্যি।