কবি অমিয় চক্রবর্তী ও তাঁর প্রতিভার অসামান্য আলো

তাঁর জীবনের সাত-সাতটি বছর কেটেছে রবীন্দ্রছায়ায়, সাহিত্য-সচিব হিসেবে; তবু তিনি রবীন্দ্রছায়ায় হারিয়ে যাননি। আধুনিক কবিদের মধ্যে স্বতন্ত্র ও স্বকীয় এক বিভা নিয়ে ‘পালাবদল’-এর ইতিহাসে অংশ নিতে নিতে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বাংলা সাহিত্যকে ধন্য করে গেছেন। 'তিনি', কবি অমিয় চক্রবর্তী

১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল হুগলির শ্রীরামপুরে অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছিল আসামের গৌরীপুরে। কারণ, তাঁর পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন তৎকালীন গৌরীপুর রাজ্যের দেওয়ান। বহু স্মৃতিবিজড়িত এই গৌরীপুর বেশ কয়েকবার অমিয়র কবিতায় স্থান পেয়েছে। [যেমন, ‘মাটি’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘…শিশু আঙিনায়/ দৌড়ে খেলে, হাট বসে, গৌরীপুরে জমে ব্যবসায়’।]

শ্রীরামপুরে শৈশবের দিনগুলো কাটিয়ে ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে গৌরীপুরে যখন থাকতে এলেন,  তখন বাবা অমিয়কে ভর্তি করে দিলেন পি সি ইন্সটিটিউশনে।

কিন্তু সে তো প্রথাগত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। আসলে, সংস্কৃতের প্রতি বাবার বেশ দুর্বলতা ছিল। এবং  যথেষ্ট ভালোবাসাও ছিল। তাই ছেলের মধ্যে সেগুলো চারিয়ে দিতেই তিনি এখানকার এক টোল-পণ্ডিত ষড়ানন তর্কতীর্থকে গৃহশিক্ষক রেখে অমিয়কে সংস্কৃত শেখানোর ব্যবস্থা করলেন।

নেওয়ার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ অমিয়র। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজিতে অল্পদিনেই বেশ দখল এসে গেল তাঁর।  তাবড় তাবড় বইপত্রও পড়ে ফেলতে লাগলেন এক এক করে। বাড়তে লাগল প্রজ্ঞার পরিধি।

তবে গৌরীপুর নিছক পিতার কর্মভূমি ছিল না, নেহাত তাঁর পুথিপাঠের ভূমিও না; সেখানকার পাকাপুল, আদিগন্ত ভেরভেরির মাঠ, লাউখাওয়া বিল, টিলার ওপর রাজাদের ‘হাওয়াখানা’ মহল, উদার প্রকৃতি তাঁকে আপন করে নিয়েছিল; সেখানকার ভাওয়াইয়া-চটকা-জারি-সারি-বাউল প্রভৃতি সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত ও হাওয়াখানার নিয়মিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর তাঁকে দিয়েছিল প্রকৃতি ও ঐতিহ্য-সম্পদকে আত্মস্থ করে নেওয়ার পাঠ। তাঁর মধ্যে সঞ্চার করেছিল নিখাদ সাঙ্গীতিক চেতনা।

কৈশোরে সঙ্গীতকে আত্মস্থ করে  যৌবনে তাকে ইউরোপীয় চেতনার মধ্য দিয়ে লালন করে পরবর্তীকালে অমিয় অনেক গান লিখেছিলেন, সুরও দিয়েছিলেন। যদিও সে-সব কালের গণ্ডি পেরিয়ে একালের দরবারে এসে পৌঁছয়নি।

গৌরীপুরে তিনি মাত্র পনের বছর বয়স পর্যন্ত সময়কাল কাটিয়েছেন। তার একটা কারণও ছিল। সেখানে প্রকৃতিপাঠ গ্রহণ করতে করতে বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে  ক্রীড়াচঞ্চল দিনগুলি কাটাতে কাটাতে হঠাৎ-ই জীবনে নেমে এসেছিল দুর্বিষহ শোক, নিদারুণ বিচ্ছেদ।

সেখানে দাদা অরুণ চক্রবর্তী হঠাৎ একদিন আত্মহত্যা করেন। এই শোক অমিয় সহ্য করতে পারেন না। পরিবারও না। তাঁরা  চলে আসেন কলকাতায়।

কলকাতারই হেয়ার স্কুল থেকে অমিয় মেট্রিক পাশ করেন ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে।

গৌরীপুরে থাকতেই কিশোর অমিয় চক্রবর্তী জর্জ বারণারড শ’, রোমা রলার মতো বিখ্যাত সাহিত্যিক-দার্শনিকদের নিয়মিত চিঠি লিখতেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও। প্রত্যেকেই তাঁর চিঠির উত্তর দিতেন। পত্রলেখক যে নেহাতই কিশোর একজন, তা কেউ বুঝতে পারেননি। কিশোর বয়সেই পাণ্ডিত্যে ও প্রজ্ঞায় অমিয় এতটাই পরিণত মনস্ক হয়ে উঠেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অমিয় চক্রবর্তী বয়সে ছিলেন চল্লিশ বছরের ছোট। তা সত্বেও প্রজ্ঞার পথ বেয়ে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে বাধেনি। পত্রালাপের সূত্র ধরে নিজে থেকেই তাঁকে সচিব হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতীতে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেনঃ

‘তুমি এম.এ দেবে বলে তোমার বিশ্বভারতীতে যোগ দেবার কোনো বাধাই হবে না। বরঞ্চ এখানে তুমি যে-কোনো সুবিধা চাও তা পাবে।’

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে অমিয় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সচিব হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার জন্য অমিয় অক্সফোর্ড গেলে এই সচিব-পর্বের সমাপ্তি ঘটে। এই সাত বছরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ওপর, তাঁর পাণ্ডিত্যের কতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, তার খবর মেলে রবীন্দ্রনাথেরই লেখা চিঠিতেঃ

‘…তুমি আমার অনেক করেচ, অনেক ক্লান্তি থেকে বাঁচিয়েছ—তোমার সহযোগিতা আমার পক্ষে বহুমূল্য হয়েছিল, সে কথা কোনোদিন ভুলতে পারবো না—কোনোদিন তোমার অভাব পূর্ণ হবে না।’

অমিয় যখন অধ্যাপনাসূত্রে বিদেশে অবস্থানকালে 'বিশ্বনাগরিক' হয়ে উঠেছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ রোগশয্যায়। অসুস্থ অবস্থাতেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই বন্ধুকেই স্মরণ করে লিখেছিলেন—

‘অকৃত্রিম তোমার মিত্রতা,

তোমার বুদ্ধির বিচিত্রতা

ভূয়োদর্শনের তব দান

বন্ধুত্বেরে করে মূল্যবান’।

এই পর্বে কর্ম ও অবস্থানসূত্রে দেশ-বিদেশের মনীষীদের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। চেতনা হোক বা ফর্ম; বিশ্বসাহিত্যের মগ্ন পাঠক হিসেবে তিনি পাশ্চাত্যের যা কিছু নতুন, যা কিছু ভালো তা আহরণ করে আপন বোধে জারিত করে বাংলা সাহিত্যের সম্পদ করেছেন। এভাবেই তাঁর কবিতার অবয়ব বেয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তন করেছেন হপকিনসের ‘স্প্রাং রিদম’ ও ফরাসি কবিতার ‘মুক্তক’—

‘বেলা সাড়ে তিনটেয় সূর্য নেমেচে

প্রকাণ্ড মোটর-লরির পায়ে ঘুঙুর, ঝিনঝিন

লণ্ডনের রাস্তায় বাজাচ্ছে ভিখিরি ইতালিয়ান

ব্যারেল অর্গান’

[‘উর্বশী’ কবিতা]

বাংলা কবিতার আপামর পাঠক অনেকাংশেই কাব্যের মুক্তিতে তাঁর এই যে অবদান, তা মনে রাখেননি।

আসলে, বাংলা কবিতার পাঠক অনুপ্রাসের মধুমাখা ‘উচ্চারণ’ পছন্দ করেন, 'উচ্চারণে' চকিত বিদ্যুৎরেখা পছন্দ করেন; অমিয় চক্রবর্তীতে তার বাহুল্য নেই, তাই তিনি আপামরের মুখে মুখে ফেরেন না।

তিনি যে বাংলা কাব্যে আধুনিকতা আবাহনের ফেরেস্তাদের একজন—এটাও অনেকে ভুলে যান। ভুলে যান, তিনি কবিতায় অনুভবের আদর ছড়াতে ছড়াতে এগোন, চেতনার চাটাই বুনতে বুনতে এগোন, বিজ্ঞান ভাবনায় রাঙাতে রাঙাতে এগোন। বলেন সংহতির কথা। বাঁচার কথা, বাঁচানোর কথাঃ

‘আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক

কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা—

আলোর গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভরে রাখুক,

আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক।।

…        …      …      …

মাটির বুকে যারাই আছি এই দুদিনের ঘরে

তার স্মরণে সবাইকে আজ ঘিরেছে আদরে।।’

[‘পিঁপড়ে’ কবিতা]

আক্ষেপ একটাই, অমিয় চক্রবর্তীর কোন উত্তরসূরি নেই

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...