যাঁদের জন্য বাংলা চলচ্চিত্রে ‘স্বর্ণযুগ’ নামের একটি যুগ চিহ্নিত হয়েছে, যাঁদের অবদানে বাংলা ছায়াছবি সেই সময়ের বাণিজ্যিক চাহিদা পূরণ করেও শিল্পসুষমামণ্ডিত ও কালজয়ী হয়ে ওঠার দিশা দেখেছিল; তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চলচ্চিত্রের আলোকচিত্রী ও পরিচালক অজয় কর।
১৯১৪ সালের ২৭ মার্চ, সিনেমার শহর কলকাতায় তাঁর জন্ম। তিনি যখন প্রায় বিশের কোঠায়, তখন বাংলা সিনেমাও নির্বাক যুগ পেরিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে। এই সময় কলেজে পড়তে পড়তে তিনি অনুভব করলেন যে, সিনেমা মাধ্যমটির প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। বিশেষত আলোকচিত্রের ভেতরে যে শিল্প, তার প্রতি তাঁর অধিক আসক্তি।
সেই সময় তো সিনেমা শেখার কোন স্কুল ছিল না। তখন বাংলার স্টুডিওগুলোর প্রত্যেকটিরই নিজস্ব ল্যাব ছিল, নিজস্ব লাইট-ক্যামেরা ছিল, মাসমাইনের ক্যামেরাম্যান ছিলেন। তাই হাতেকলমে সিনেমার কলাকৌশল শিখবার জন্য এমন পাঠশালা আর দুটি ছিল না।
ফলে অজয় কলেজের পাঠ চুকিয়ে ম্যাডানদের স্টুডিওতে যোগ দিলেন। যেহেতু তাঁর স্বপ্ন ছিল আলোকচিত্রী হবেন, তাই প্রথমে তাঁর স্থান হল স্টুডিয়োর ল্যাবরেটরিতে। সেখানে শিখতে শুরু করলেন ফিল্ম প্রসেসিং-এর কলাকৌশল।
এভাবে ল্যাবরেটরির কাজ ভালোভাবে শেখার পর তবেই একদিন অজয় ক্যামেরা ছোঁয়ার সুযোগ পেলেন। কিছুদিন গেল ক্যামেরার যত্নআত্তি জানতে। তারপর ক্রমে স্টুডিয়োর মাসমাইনের আলোকচিত্রী যতীন দাসের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেন।
আলোকচিত্রের প্রতি অজয়ের অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও আগ্রহ দেখে যতীনবাবুর বেশ ভালো লাগল। মনে বাৎসল্য জাগল। শুরু করলেন বাৎসল্য উজাড় করে তাঁকে শেখাতে। দুরন্ত মেধায় অল্পসময়েই লাইট তৈরি ও ক্যামেরা পরিচালনার সমস্ত খুঁটিনাটি অজয় শিখে ফেললেন। তাঁর এই শিক্ষা পরিশীলিত হল অসংখ্য বিদেশি ছবিতে দেখা লাইটপ্যাটার্ন ও ক্যামেরা-পরিচালনা পদ্ধতি আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে।
যতীনবাবুর শিক্ষা, সহযোগিতা ও আপন মেধার মিলনে বছর সাতের মধ্যেই অজয় কর হয়ে উঠলেন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ আলোকচিত্রী। এবং, ১৯৩৯ সালে চারু রায়ের ‘পথিক’ ছবিতে স্বাধীন আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটল।
‘পথিক’ ছবিতে অজয়ের আলো এবং ক্যামেরা-পরিচালনা দেখে সেই সময়ের পরিচালকেরা তাঁকে নিয়ে কাজ করতে দারুণ উৎসাহী হয়ে পড়লেন। ফলত একে একে দেবকী বসু, নীরেন লাহিড়ী, হেমেন গুপ্ত, সত্যেন বোস প্রমুখ বিশিষ্ট চিত্রপরিচালকদের ছবিতে কাজ করে ফেললেন। এ-যেন তাঁর জীবনের এক সুবর্ণ সুযোগ। কেননা, এঁদের সঙ্গে কাজ করে অজয় যেমন আরও ঋদ্ধ হলেন, অভিজ্ঞ হলেন; তেমনি আরও নন্দিত হলেন।
ঠিক এই সময়েই, সেই সময়ের সুবিখ্যাত নায়িকা কান্নদেবীর স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য চিত্রপরিচালনায় আসার কথা ভাবলেন। চলচ্চিত্রের কয়েকজন কৃতী কলাকুশলীকে নিয়ে যৌথভাবে চিত্রপরিচালনার পরিকল্পনাও করে ফেললেন। ‘সব্যসাচী’ নামে তৈরি হল গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীতে যোগ দিলেন অজয় কর। একে একে ‘অনন্যা’ (১৯৪৯), ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯৪৯), ‘মেজদিদি’ (১৯৫০) ইত্যাদি ছবিতে গোষ্ঠীগত পরিচালনার কাজ করে তিনি চিত্রপরিচালনায় দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন।
ফলে পরের বছরই স্বাধীন আলোকচিত্রী ও চিত্রপরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেরি বা দ্বিধা কোনটাই করলেন না। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউণ্ড অব বাস্কারভিলস’ রহস্য-উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে তৈরি করলেন ‘জিঘাংসা’ (১৯৫১) ছবিটি। সাদাকালো সেলুলয়েডে আলো-আঁধারি ও ক্যামেরা দিয়ে তিনি যে রহস্যময়তা সৃজন করলেন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তাকে সুষমামণ্ডিত করল। ফলত দুর্দান্ত অভিনয় সমৃদ্ধ এই ছবিটি দর্শক বিপুলভাবে গ্রহণ করল। সবদিক থেকে ‘জিঘাংসা’ হয়ে উঠল মাইলস্টোন।
তারপর একে একে ‘শ্যামলী’ (১৯৫৬), ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭), ‘শুন বরনারী’ (১৯৬০),‘সপ্তপদী’ (১৯৬১), ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩), ‘পরিণীতা’ (১৯৬৯)- প্রভৃতি মাইলস্টোনের সম্ভার। ক্যামেরার কাজ, পরিচালনা, অভিনয়- এই ছবিগুলোতে এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, বাংলা সিনেমার ইতিহাস নিয়ে, ঐতিহ্য নিয়ে, শিল্পগুণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এদের বাদ দিলে আলোচনা কখনই সম্পূর্ণ হবে না।
বাংলা সিনেমায় অজয় করের সবচেয়ে বড় অবদান হল, ব্যাক-প্রজেকশন। তিনি যে শুধু ব্যাক-প্রজেকশনের জনক তাই নয়, তা যে কতটা নিখুঁত হতে পারে, তার শেষ কথা ছিলেন তিনি।
সেই সময় এখনকার মতো চলন্ত গাড়িতে চরিত্রের সম্মুখে ক্যামেরা বসিয়ে রাস্তায় রাস্তায় শ্যুটিং করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। তাতে ফটোগ্রাফি ভালো হতে চাইত না। এই কারিগরী সমস্যা তখন ব্যাপকভাবেই ছিল। তাই আলাদা করে রাস্তাঘাটের দৃশ্য তুলে এনে স্টুডিওর ভেতর পেছনের পর্দায় সেটা প্রজেকটর দিয়ে চালিয়ে, সামনে ক্যারেকটার রেখে শ্যুট করা হত। এতে মনে হত যেন চরিত্রেরা আউটডোরেই রয়েছে। শ্যুটিং-এর এই পদ্ধতিকে বলা হত, ‘ব্যাক-প্রজেকশন’। ব্যাপারটা খুব সোজা ছিল না। এটা করতে হত অনেক হিসেবে কষে। তবে এ-ব্যাপারে অজয় কর ছিলেন একেবারে মাস্টার।
অজয় করের ‘সপ্তপদী’ ছবির ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটি সার্থক ব্যাক-প্রজেকশনের সর্বকালের সেরা উদাহরণ। গানটির কিছু অংশ সত্যিকারের আউটডোরে তোলা, কিছু অংশ স্টুডিওর ভেতরে ব্যাক-প্রজেকশন করে তোলা। এই দুটোকে তিনি এমন সুন্দর ও শিল্পসম্মতভাবে মিলিয়েছেন যে, আলাদা করে কোনটা ইনডোরে তোলা, কোনটা আউটডোরে তোলা বোঝার উপায় নেই।
অজয় কর আলোকচিত্রে সাদাকালো যুগের সার্থক শিল্পী হয়েও পরিবর্তিত ট্রেন্ডকে গ্রহণ করতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না, অধ্যাবসায়েরও অন্ত ছিল না। সাতের শেষ থেকে শুরু করে আটের দশকে যখন বাংলা সিনেমায় রঙিন ছবির জোয়ার এল, তখনও তিনি যথেষ্ট সক্রিয় ও অভিজ্ঞ; তবু অভিজ্ঞতার অহ্নগ নিয়ে অধ্যাবসায়কে দূরে ঠেলে দেননি। বিলেতে গিয়ে রঙিন ছবি তোলা ও প্রসেস করার প্রতিটি অধ্যায় শিখে এসে তারপর রঙিন ছবি তৈরিতে হাত দিয়েছেন। তাঁর শেষ ছবি ‘মধুবন’ (১৯৮৩) ও ‘বিষবৃক্ষ’ (১৯৮৩)-এই ধারারই ফসল।
অধ্যাবসায় ও অবদানের নিরিখে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘অজয় কর’ তাই একটি বিশিষ্ট অধ্যায়ের নাম। সেই অধ্যায় জানিয়ে যায়, বাংলা সিনেমার ‘স্বর্ণযুগ’ কেন ‘স্বর্ণযুগ’, কেন চিরস্মরণীয়, কেন চিরকালীন, তার সগৌরব উত্তর…