আমরা জানি, প্রবল জনপ্রিয়তা থাকতে থাকতেই অভিনয়-জগতের দুর্নিবার আকর্ষণকে বিদায় জানিয়ে অন্তরালবাসিনী হয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু, এমন নির্মোহ সিদ্ধান্ত তিনিই প্রথম নিয়েছিলেন, এমনটা নয়। তাঁরও একজন পূর্বসূরী ছিলেন। যাঁর নাম, বিনোদিনী দাসী। যাঁকে প্রায় সকলেই চেনেন, 'নটি বিনোদিনী' নামে। আজ বলছি তাঁরই কথা:
কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে খাপরার চালের দুই চিলতে ঘর। ঘরের একদিকে বিনোদিনী ও দিদিমা থাকতেন, অন্যদিকটা দিদিমা ভাড়া দিয়েছিলেন সেকালের থিয়েটার-অভিনেত্রী গঙ্গামণি বাঈকে। এই ভাড়ার টাকাতেই কোনরকমে দিদিমার সংসারের মাসকাবারি খরচ চলত।
ফলে, অসুখ-বিসুখ পাল-পার্বণে খরচ সামান্য বাড়লেই অভাব একেবারে হামলে পড়ত শিয়রে। সেই অভাবের তাড়নাতেই বাপ-মা মরা বিনোদিনী এলেন থিয়েটারে অভিনয় করতে। মাত্র এগারো-বারো বছর বয়সে।
আসলে, মা-বাবা দুজনেই যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন বিনোদিনীর বয়স একেবারেই অল্প। তাই মানুষ হচ্ছিলেন ঠাকুমার কাছে। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের খাপরার চালের ওই ঘরটিতে।
সেখানেই হঠাৎ একদিন মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় বিনোদিনীর। ঠাকুমাই দিয়েছিলেন। পাত্রও নাবালক। খাপরা-ঘরের পাশেই তার মাসির বাড়ি। সচ্ছল পরিবার। ঠাকুমা ভেবেছিলেন, তাঁর হঠাৎ কিছু হয়ে গেলেও নাতনিটা অন্তত বউ হয়ে পরের দোরে পড়ে থেকে খেয়েপরে বাঁচবে। বানের জলে ভেসে তো আর যাবে না!
ওই ভাবাই সার! বানে ভাসা যার নিয়তি, খড়কুটোও তার নাগালে থাকে না। তাই বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বরের মাসি দুম করে নাবালকটিকে কোথায় নিয়ে যে চলে গেলেন, আর হদিশ পাওয়া গেল না।
তবে হদিশ যে কোনদিনই পাওয়া যায়নি, এমনও নয়। বেশ ক'বছর পর বিনোদিনী খবর পেয়েছিলেন যে, ছেলেটি আবার বিয়ে করে সংসার করেছে!...
যাক...যেখান থেকে শুরু করছিলাম, সেখানেই বরং ফিরে যাই...যা বলছিলাম, বিনোদিনীদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন গঙ্গামণি বাঈ...
গঙ্গামণি থিয়েটারে অভিনয় করতেন তো, তাই ভালো গানও জানতেন। বিনোদিনী তাঁর কাছে গান শিখতেন। অভাব দেখে গঙ্গামণিই একদিন ঠাকুমাকে বললেন যে, বিনোদিনীকে যদি তিনি থিয়েটারে দেন, তাহলে প্রথমে সে জলপানির টাকা পাবে, কাজকর্ম শিখলে পরে মাইনেও পাবে। রোজগারের একটা পাকা সংস্থান হবে ভেবে ঠাকুমাও বিনোদিনীকে থিয়েটারে পাঠাতে আনন্দের সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন।
ব্যস, মাসিক দশটাকা বেতনে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দিলেন বিনোদিনী। অভিনয় শিখে প্রতিভা আর সৌন্দর্য দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সকলের মন জয় করে ফেললেন।
অবস্থা যখন এ-রকম, তখন বাবুভায়া এক জমিদারপুত্রের সঙ্গে তৈরি হল তাঁর প্রেমের সম্পর্ক।বিনোদিনী তাঁকে সত্যিকারের ভালবাসলেন। ছেলেটিও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিল।
কিন্তু মানুষ চিনতে ভুল করেছিলেন বিনোদিনী। ফলে, সেই ভুলের সম্মান রেখে জমিদারপুত্রটি তাঁকে ঠকাল। তাঁকে রক্ষিতায় পরিণত করে অন্যত্র লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলল।
ভাঙা মন নিয়ে বিনোদিনী যখন বিধ্বস্ত, সেই সময় গুর্মুখ রায় নামে এক বখাটে মাড়োয়ারি ছোকরা বিনোদিনীর প্রেমে পড়ল। প্রথমবারের দুঃসহ অভিজ্ঞতা বিনোদিনীকে হৃদয়-অবাধ্য হতে বাধা দিল। ফলে, গুর্মুখের শত নিবেদনেও তিনি সাড়া দিলেন না।
গুর্মুখ বখাটে ঠিকই, কিন্তু হৃদয়টি তার বিনোদিনীতে সত্যই নিবেদিত। সেখান থেকেই বিনোদিনীকে সে চাইতে এসেছিল। গুর্মুখ ধনীর ছেলে। তাই নিবেদনে না-পেয়ে ধনীর ছেলের মতো করেই পেতে চাইল। সুতরাং, বাধ্য হয়েই এবার বাঁধা নাড়ায় টান দিতে গেল সে।
গেল বিনোদিনীর গুরু গিরিশচন্দ্রের কাছে। টোপ দিল-বিনোদিনীকে সে যদি পায়, তাহলে গিরিশচন্দ্রের নাট্যদলের জন্য একটি নতুন থিয়েটার-মঞ্চ তৈরি করে দেবে।
গিরিশ বহুদিন থেকেই চাইছিলেন নিজস্ব একটি মঞ্চ। কিন্তু, কড়ি ফাঁসাবার মতো মুরুব্বি পাচ্ছিলেন না। এখন যখন সেই ভাবনার রূপসাগরে গুর্মুখ নিজে এসে ধরা দিলেন, তখন তাকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
সুতরাং, দল ও গিরিশ বিনোদিনীকে গুর্মুখ রায়ের 'হয়ে উঠতে' চাপ দিতে লাগলেন। হৃদয়পোড়া বিনোদিনী এ-প্রস্তাবে কিছুতেই সম্মত হতে পারছিলেন না। গুরুর পীড়াপীড়িতেও না।
হৃদয়াবেগে ঘা মেরে যখন কিছু হল না, তখন ষড়রিপুর অন্যতমটিকে হাতিয়ার করা হল। ক্রমাগত লোভ দেখানো হতে লাগল যে, দলের জন্য গুর্মুখ যে-মঞ্চটি করে দেবেন, সে-মঞ্চের নাম দেওয়া হবে বিনোদিনীর নামে।
বিনোদিনী নটি। তথাকথিত সতীত্বের পরাকাষ্ঠায় ভ্রষ্টা।গুরু বলেন-'দেহপট সনে নট সকলি হারায়'! এ-কথা যে একজন নটির জন্য কতটা সত্য, সেই নজিরের তো অভাব নেই। কত এল, কত গেল। তাহলে? তাহলে কীসের জোরে বেঁচে থাকবেন বিনোদিনী? শুধু অভিনয়ের জোরে? তা-ই কি মানুষ চিরদিন মনে রাখবে? কে জানে! ভারি সাধ হল স্মরণীয় হতে। লোভ হল লোকমুখে বহুকাল চিরকাল বেঁচে থাকতে। তখন দোলাচলতার দোলক থামল।
বিনোদিনী গুর্মুখের আশ্রয়ে এলেন। নাট্যমঞ্চও তৈরি হল। কিন্তু, মঞ্চের নাম?
উঁহু, বিনোদিনীর নামে দেওয়া হল না। কেন?
একজন ভ্রষ্টা-নটির নামে মঞ্চ হলে সেখানে কী কোন ভদ্দরলোক পরিবার নিয়ে নাটক দেখতে আসবেন? ভদ্রসমাজে মঞ্চের নাম উচ্চারণ করতে পারবেন?...এই সব কতরকম ব্যবসায়িক ভাবনা মাথায় খেলতে লাগল, গিরিশ এবং দলের।
বিনোদিনীকে পাবার জন্য ভদ্দরপুরুষ মরিয়া হতে পারেন, তাঁর নামে নাটকের টিকিট বিকোতে পারে, তাঁর নাটক ভদ্দরলোক সপরিবারে দেখতে পারেন; অথচ তাঁর নামাঙ্কিত মঞ্চ ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ হবে? উঁহু, এটা একেবারেই মানা যায় না।
আসলে, ওসব কিছুই না। গিরিশ দলের হোতা, নাট্যকার; যাঁর রচিত ও পরিচালিত নাটকে অভিনয় করে বিনোদিনীর নামধাম; যিনি নিজেও একজন প্রখ্যাত নট; যাঁর নামেও লোকে টিকিট কাটে; সেই গিরিশের নামে মঞ্চের নাম না-হয়ে সামান্য একজন নটির নামে মঞ্চের নাম হবে--দলে এটাই কেউ মানতে পারল না। মন থেকে সম্ভবত গিরিশও না।
কিন্তু, দলের কথায় বিনোদিনী যে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, গিরিশ যে তাঁকে কথা দিয়েছেন, তার কী হবে! কী আর হবে, খেলাপিতে চুলোয় যাবে! হ্যাঁ, চুলোতেই গেল। গিয়ে নাট্যমঞ্চের নাম হল, 'স্টার থিয়েটার'।
বলা বাহুল্য, গিরিশ ও দলের মিথ্যাচারিতায় বিনোদিনী মারাত্মক আঘাত পেলেন। তবু সেটাকেই গুরুর দান মনে করে সান্ত্বনা খুঁজলেন, সঙ্গ ত্যাগ করলেন না।
দিনের পর দিন গেল।
তারপর একদা স্টারে শুরু হল গিরিশের লেখা 'চৈতন্যলীলা' নাটক। সেই নাটক দেখতে এলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব। বিনোদিনীর অভিনয় দেখে খুব খুশি হলেন। এতটাই খুশি হলেন যে, নিজে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। আশীর্বাদ করে বললেন, 'তোর চৈতন্য হোক'। আর কানে দিলেন ইষ্টমন্ত্র।
গুরুর চাপে পড়ে গুর্মুখের হতে হলেও সত্যিকারের ভালোবাসা পেয়ে বিনোদিনী যখন মানুষটাকে একান্ত আপনার করে নিয়েছেন, তখনই এল দ্বিতীয় আঘাত। বাপমায়ের প্রবল তাড়নায় বিনোদিনীকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হলেন গুর্মুখ। তাঁদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়েও করতে বাধ্য হলেন।
আঘাত পেলেও বিনোদিনী যেমন গুর্মুখকে ভোলার কথা ভাবতে পারলেন না, তেমনি বিনোদিনীকেও ভুলতে পারলেন না গুর্মুখ। তাঁর মস্তিষ্কের বিকার ঘটল। বাড়ি থেকে পালিয়ে একা কাশীতে গিয়ে হাজির হলেন। কিছুদিন সাধুসঙ্গ করলেন। তারপর একদিন হঠাৎ করেই মাত্র বাইশ বছর বয়সে মারা গেলেন। শোকসংবাদ পৌঁছল বিনোদিনীর কাছে।
কিন্তু, এই শোক বিনোদিনী সহ্য করতে পারলেন না। তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে, তবুও সবকিছু কেমন বিস্বাদ মনে হল। সিদ্ধান্ত নিলেন আত্ম-নির্বাসনের। বারো বছরের অভিনয় জীবন থেকে দুম করে সরে গেলেন। চলে গেলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। বরণ করলেন এক অসহায় কষ্টের জীবন। স্বেচ্ছায়।
দীর্ঘকাল পর তাঁর স্বনির্বাসিত জীবনে কষ্ট ভাগ করে নিতে স্বেচ্ছায় আর-একজন এলেন। বিনোদিনী তাঁকে বিয়ে করলেন। কিন্তু, সংসারে সুখ এল না; এল অকাল বৈধব্য। সম্বল হল শুধু রামকৃষ্ণদেবের দেওয়া গুরুমন্ত্র। তাই-ই সহায় করে চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কাটাতে লাগলেন সাধিকার জীবন।
জীবন থামল আটাত্তর বছর বয়সে। ১৯৪১সালে। যে সংবাদপত্রটি তাঁকে এককালে ‘ফ্লাওয়ার অব নেটিভ স্টেজ’ বলে অভিহিত করত, তারা তাঁর মৃত্যুর খবরে কোনও আগ্রহ দেখাল না। এক নটির জীবন নীরবে-নিভৃতে শেষ হয়ে গেল, কেউ জানলই না...
ঋণ: 'আমার কথা'-বিনোদিনী দাসী।