ছোট ছোট ছয় ভাইবোন। বাবা নেই। সংসারের ভার নিয়ে অকুল পাথারে মা। কী করে দিন গুজরান হবে কোনও ঠিক নেই।দায় কাঁধে নিল একরত্তি বড়দিদি। বয়স তার তখন মেরেকেটে আট।
বাবা ছিলেন অভিনেতা। ‘মাস্টার বিনায়ক’ নামে তাঁকে চিনত স্টুডিয়োপাড়া। মা মীনাক্ষী। ১৯৩৯-এর ৮ জানুয়ারী জন্ম হয় তাঁদের দ্বিতীয় কন্যা নন্দার।
স্টুডিয়ো পাড়া তাকে চিনতে শুরু করল ‘বেবি নন্দা’ নামে। অনাবিল শিশুমুখ মায়া কেড়েছিল দর্শকদের। কিশোরী বয়স তো বটেই যৌবনে পা দিয়েও নিটোল মুখে শিশুর ছায়া আলাদা করে তাঁকে চিনিয়ে দিত ষাটের দশকের বলিউড নায়িকাদের ভিড়ে।প্রথম বড় ব্রেক এল কাকা ভি.শান্তারামের ছবির সূত্রে। ১৯৫৬-তে ভাইবোনের গল্প নিয়ে ছবি ‘তুফান অউর দিয়া’। হিট হয়েছিল সেই ছবি।
১৯৬০-এ ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাকট্রেস’ হিসেবে ফিল্মফেয়ার সম্মান পেয়েছিলেন ‘আঁচল’ ছবির জন্য। শশী কাপুরের সঙ্গে জুটি বেঁধে সই করেছিলেন টানা ৮ ছবিতে। শশী কাপুর তখন তাঁর সেরা সময়ে। কিন্তু নন্দার সঙ্গে তাঁর রসায়ন ছিল আশ্চর্য স্নিগ্ধ। শশী কাপুর প্রায়ই পছন্দের অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর কথা বলতেন।
স্বাধীনতার পরে দ্রুত বদলে যাচ্ছিল মধ্যবিত্ত ভারতীয় অন্দর। ঘরকন্নায় আধুনিকতার ছোঁয়া, সাগরপারের সংস্কৃতির ঢেউ লাগতে শুরু করেছে ব্যবহারিক জীবনে। কিন্তু তার মূল সুরটি নিখাদ ভারতীয় মেজাজে।নন্দার মধ্যে সেই দিকটিকেই খুঁজে পেয়েছিল ভারতীয় ছবির দর্শকরা।নন্দার মারাঠি সৌন্দর্য এক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছিল বলা যায়।
রাজেশ খান্নার বিপরীতে ‘ইত্তেফাক’, ‘জরু কা গুলাম’, ‘দ্য ট্রেন’। পর্দায় কাজ করেছিল তাঁদের রসায়ন। নন্দা তখন বড় তারকা। তিনি ‘দ্য ট্রেন’ ছবির সহ প্রযোজক রাজেন্দ্র কুমারকে রাজি করিয়েছিলেন তাঁর ছবিতে রাজেশকে কাস্ট করার জন্য। হিট হয়েছিল ছবি।
চরিত্র প্রধান অভিনেত্রীর না, সহযোগী অভিনেত্রীর এ নিয়ে কোনও ছুৎমার্গ ছিল না নন্দার । দুই ভূমিকাতেই তাঁর সমান সাফল্য এসেছিল। চিত্রনাট্য যে শুধুমাত্র নায়ক আর নায়িকা নিয়ে নয়, প্রতিটি চরিত্রই সমান জরুরি বারবার বুঝিয়ে দিতেন অভিনয়ে।১৯৬৯-তে ‘ইত্তেফাক’ ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ১৯৮১ এবং ৮২-তে ‘আইস্থা আইস্থা’, ‘প্রেমরোগ’ ছবির জন্য পরপর দু’বার সেরা সহঅভিনেত্রীর মনোনয়ন।
সত্তর দশক থেকে আরও বেশি করে সহঅভিনেত্রীর ভূমিকায় দেখা যেত লাগল নন্দাকে। নায়িকাদের সেরা হওয়ার রেসে কোনদিন সেভাবে তিনি ছিলেন না। কিন্তু ষাটের দশকে পারিশ্রমিকের রেটিং-এ দু’নম্বর, সত্তরের দশকে তিন নম্বরে। ওয়াহিদা রহমান, নূতনের পরেই। সাধনা শিবদাসানি ছিলেন এক ব্র্যাকেটে।
একেবারে অন্য মনের মানুষ ছিলেন নন্দা। তাঁর আর ওয়াহিদা রহমানের বন্ধুত্ব আজও ইন্ড্রাস্ট্রির জটিল আবর্তে উদাহরণ হয়ে আছে। ১৯৬০-এ ‘কালাবাজার’ ছবির সেটে যার সূত্রপাত। নন্দা-ওয়াহিদা দুজনেই দুজনের প্রিয়তম বন্ধু। আজীবন অবিচ্ছেদ্য ছিলেন তাঁরা।
আরও দুই অভিনেত্রী ছিলেন নন্দার কাছের মানুষ। সাধনা শিবদাসানি আর আশা পারেখ। মাঝে মাঝেই তাঁরা মিলিত হতেন নিজস্ব বৃত্তে।
বারবার প্রেম এসেছে নন্দার জীবনে। লাইমলাইটকে উপভোগ করেছেন রানীর মতো। জনপ্রিয় নায়করা তাঁর প্রেমে পড়েছেন। এসেছে বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু সম্পর্কে থিতু হতে পারেননি নন্দা। একদিকে সংসারভার অন্যদিকে ছবি জীবন মাঝখানে কিছু নেই। কিন্তু একবার ধরা তিনি দিয়েছিলেন। সেই গল্পের নেপথ্যেও প্রিয় বান্ধবী ওয়াহিদা।
এই কাহিনির শুরুটা ষাটের দশকে। নন্দা তখন বোম্বাই ইন্ড্রাস্ট্রিতে ‘বিগ নেম’। কাজ করছেন দেবানন্দ, রাজ কাপুর, রাজেন্দ্র কুমারের সঙ্গে। ‘যব যব ফুল খিলে’, ‘পরিনীতা’, ‘প্রেম রোগ’-এর মতো হিট ছবির অভিনেত্রী। আলাদা ফ্যানবেস তৈরি হয়েছে তাঁর জন্য। সেই ফ্যানকুলের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেমন আছেন তেমনি বাদ নেই তারকারাও।
এমনই মুখ মনমোহন দেশাই। ‘অমর-আকবর-অ্যান্টনি’, ‘সুহাগ’, ‘নসীব’, ‘কুলি’, ‘মর্দ’, ‘গঙ্গ-যমুনা’র মতো ছবির পরিচালক। ভীষণ ভালো সম্পর্ক অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে।
মনমোহন দেশাই প্রেমে পড়েছিলেন নন্দার। কোনওদিন বলতে পারেননি সে কথা। বিয়ে হয়ে যায় জীবনপ্রভার গান্ধীর সঙ্গে। সেখানেই শেষ হয়ে যেত পারত এই গল্প। বলতে চেয়েও হারিয়ে যায় যেভাবে অনুভূতিরা। মনমোহন দেশাইয়ের গল্পটা আকস্মিকই গতিপথ বদলালো।
হঠাৎ অসুস্থতায় মৃত্যু হয় জীবনপ্রভার। ফের একা মনমোহন। ফের জীবনে নন্দা-নদীর টান। এবার আর ভুল করেননি। মাধ্যম হন ওয়াহিদা। নন্দাকে রাজী করান।
নতুন জীবন শুরুর পথে এগিয়ে, হয়ে গিয়েছিল বাগদানও। কিন্তু বিপর্যয় বদলে দিল পরিনতিটুকুকে। স্তম্ভিত হয়ে হয়েছিল গোটা বলিউড!
১৯৯৪-এর মার্চ। মাসের প্রথম দিন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন মনোহর। রেলিং ভেঙে একেবারে মাটিতে। কিচ্ছু করতে পারেননি চিকিৎসকরা। প্রয়াত হলেন নন্দার শেষ প্রেমিক। আর কোনদিন ঘর বাঁধার কথা ভাবেননি তিনি।
বাকি জীবন একেবারে অন্তরালে। একাই থাকতেন। একবারই ফিরেছিলেন পর্দায়। সেবারও প্রিয় বান্ধবীর জোরাজুরিতেই। ২০১০-এ মারাঠি ছবি ‘নটরঙ্গ’তে। অতিথি শিল্পী হিসেবে স্ক্রিন শেয়ার করেছিলেন ওয়াহিদার সঙ্গে। আর কখনও দেখা যায়নি তাঁকে।২০১৪-র ২৪ মার্চ নিজের বাড়িতেই নিভে গেলেন এই তারা। আরব সাগরের ঢেউয়ের শব্দ তখনও লেগেছিল কানে...