'আরতি' নামের নায়িকা-সংবাদ

মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল আরতির। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতাতেই একটা হিন্দি ছবিতে হিরোইনের রোল পেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন সর্বভারতীয় দর্শক হিরোইন আরতি ভট্টাচার্যকে আপন করে নেবে, হাতে একের পর এক ভালো কাজ আসবে-তাই প্রাণ ঢেলে কাজও করছিলেন। কিন্তু, ক'দিন শ্যুটিং হওয়ার পর হঠাতই ছবির কপালে শনি জুটল, মাঝপথে শ্যুটিং বন্ধ করে বোম্বের প্রোডিউসার ইউনিট নিয়ে চলে গেলেন। ছবি আর শেষ হল না। ছবির নাম ছিল, 'রিওয়াজ'। আসলে, জামসেদপুরে জন্মানো এবং বেড়ে ওঠা আরতি হিন্দি ও ইংরেজিতে এক্কেবারে চোস্ত। তাই হিন্দি ছবিতে কাজ পেতে একদম অসুবিধে হয়নি। কিন্তু, স্বপ্নপূরণের পথে যাত্রা শুরুতে যেই বাধা পড়ল; স্বাভাবিকভাবেই অমনি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

ছোট থেকেই আরতি যে অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, এমনটা কিন্তু নয়। তখন তাঁর ডাক্তার হওয়ার কী যে প্রবল ইচ্ছে হত, মনের মধ্যে সবসময় ঘোরাফেরা করত গলায় স্টেথো ঝোলানো রুগির সেবায় মগ্ন এক লেডি ডাক্তার। কিন্তু, আর পাঁচজনের জীবনে ছোটবেলার স্বপ্ন যেমন বদলে বদলে যায়, স্বপ্নের বাঁকবদল হয়, স্বপ্নের ইচ্ছেরা ধীরে ধীরে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়; আরতির জীবনেও তাই-ই ঘটল। স্কুলের ড্রামা কম্পিটিশনে বছরের পর বছর ফার্স্ট প্রাইজ এবং অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেতে পেতে মনের কোনে একটু একটু করে জায়গা করে নিতে লাগল অভিনেত্রী হওয়ার ইচ্ছে। স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকলেন। ততদিনে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে একবার কলকাতায় গিয়ে সিনেমায় অভিনয়ের চেষ্টার জন্য কার্যত এমনভাবে ক্রমাগত তাড়া দিতে লাগলেন যে, সেই অনুপ্রেরণার চোটে পড়া শেষ না-করেই মায়ের হাত ধরে তিনি কলকাতায় চলে এলেন। ঠিক কলকাতায় না, মামার বাড়ি চুঁচুড়ায়।

শুরু হল প্রোডিউসারদের দরজায় ঘোরাঘুরির পালা। জামসেদপুরে বড় হওয়ায় আরতির বাংলা কথাবার্তায় একটা আড়ষ্টতা ছিল, ফলে, বাংলা ছবিতে কাজ পাওয়া প্রায় দুষ্কর হয়ে উঠল। এইরকম পরিস্থিতিতে দেবদূতের মতো হিন্দি ছবির প্রোডিউসারটি বোম্বে থেকে এসে তাঁকে ছবির হিরোইন করে, মনের মধ্যে অভিনেত্রী হওয়ার ইচ্ছেটাকে পূর্ণমাত্রায় জাগিয়ে দিয়ে ছবি ডকে তুলে যমদূতের মতো চলে গেলেন। আরতি জেদি মেয়ে, তাই ভেঙে পড়লেন না, জামসেদপুর ফিরে গেলেন না, হালও ছাড়লেন না।

অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় সে-সময় 'নহবত' নামের একটি নাটক করবেন বলে ঠিক করেছেন। নায়িকা 'কেয়া'-চরিত্রের জন্য মেয়ে খুঁজছেন। পাকেচক্রে পেয়ে গেলেন আরতিকে। তাঁর মনে হল, চরিত্রের জন্য এ-মেয়ে নির্ঘাত মানানসই। ফলে, হাতছাড়া করার প্রশ্নই উঠল না। পেশাদার অভিনয় ও ভাষায় যেটুকু আড়ষ্টতা ছিল, তার জন্য তাঁকে বিখ্যাত অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের হেফাজতে পাঠিয়ে মেজেঘষে একেবারে ঝকঝকে করে ফেললেন। নাটক হিসেবে 'নহবত' মাইলস্টোন হয়ে গেল, হিরোইন তথা সুঅভিনেত্রী হিসেবে সবার চোখে পড়ে গেলেন আরতি।

মৃণাল সেন থিয়েটার থেকে প্রচুর প্রতিভাবান অভিনেতা-অভিনেত্রীকে সিনেমায় সুযোগ দিয়েছেন। বলা ভালো, মৃণাল সেনের মতো পরিচালকেরা চরিত্রের প্রয়োজনে যাঁকে যখন প্রয়োজন হয়েছে, তাঁকে ঠিক খুঁজে নিয়েছেন, তিনি নতুন হলে তাঁকে তৈরি করে নিয়েছেন। এসময় মৃণাল 'এক অধুরি কাহানি' নামের একটি হিন্দি ছবি করবেন বলে ঠিক করেছেন। তাতে একটি ডাকাবুকো হিন্দিভাষী মেয়ের প্রয়োজন। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কানে উঠল আরতির নাম। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় আরতিকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর কাছে। অডিশন নিয়ে মৃণালও জানিয়ে দিলেন, এই মেয়েকেই তাঁর চাই। ব্যস, ছবি হয়ে গেল। ছিল প্রতিভা ও চেষ্টা। প্রয়োজন ছিল যোগাযোগের, তাও হয়ে গেল।

মৃণাল সেনের ছবিটির ডাবিং দেখতে গিয়েছিলেন পরিচালক সলিল দত্ত। সেখানে আরতির অভিনয় দেখে তাঁরও ভালো লেগে গেল। আবার যোগাযোগ। একইসঙ্গে উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দুই মহারথীর নায়িকা হয়ে গেলেন 'স্ত্রী' ছবিতে। 'এক অধুরি কাহানি' আগে নির্মিত হলেও 'স্ত্রী'(১৯৭২) আরতির প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি। প্রথম ছবি হলেও উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুই দাপুটে অভিনেতার প্রভায় ঢাকা পড়ে গেলেন না আরতি, নিজের আভায় আলোকিত হয়ে সবার নজর কাড়লেন। পেলেন দর্শকের ভালোবাসা। আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হল না। একে একে রিলিজ করতে লাগল তাঁর একের পর এক ছবি--'পিকনিক', 'আমি সে ও সখা', 'জাল সন্ন্যাসী', 'জব চার্ণকের বিবি', 'নিশান', 'অসাধারণ', 'আনন্দমেলা', 'প্রেয়সী', 'নন্দিতা'। ১৯৭২ থেকে ৮২-এই দশ বছর বাংলা ছবিতে তাঁর অভিনয়জীবন। মাত্র এই দশ বছরেই তিনি অভিনয় করেছেন চল্লিশটিরও বেশি ছবিতে। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জ, দীপঙ্কর দে, রঞ্জিত মল্লিকের বিপরীতে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে বাংলা ছবির ইতিহাসে নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান চিরদিনের আসনে পাকা করে নিয়েছেন।

আরতি আর অভিনয় করেন না। স্ক্রিপ্ট লেখেন, পরিচালনা করেন হিন্দি এবং ভোজপুরি ছবির জগতে। বিরাশি সালে ভোজপুরি ছবির নায়ক কুণাল সিং-কে বিয়ে করে সংসার সামলানোর পাশাপাশি বেছে নিয়েছিলেন লেখালেখির কাজ, ক্যামেরার পিছনের জগৎ। সেই জগতে এখনও তিনি স্বমহিমায় স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল। তবে, আরতি ভট্টাচার্য আমাদের কাছে বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়, একটি বিশিষ্ট সময়ের প্রতিনিধি, অসাধারণ অভিনেত্রী, একইসঙ্গে আটপৌরে এবং মোহময়ী নায়িকা, এখনও...



তথ্যঋণ: আরতি ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকার--'স্টার অ্যান্ড স্টাইল' ম্যাগাজিন, ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সংখ্যা এবং 'আজকাল' পত্রিকা, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...