তাঁর দাদা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একচ্ছত্র অধিপতি, মহানায়ক। কিন্তু সেই অতি বিখ্যাত দাদাও অভিনয়ের ক্ষেত্রে সমীহ করতেন ছোট ভাই "বুড়ো"-কে। তিন ভাইয়ের সর্ব কনিষ্ঠ হলেও ডাকনাম ছিল তাঁর "বুড়ো"। খুব ছোট্ট থাকতেই তিনি স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে শিখে গিয়েছিলেন তাই তাঁর ঠাকুরমা আদর করে নাম রাখলেন বুড়ো। সেই নামেই ডাকতেন তাঁকে তাঁর পরিজনেরা।
তাঁর দাদা বলতেন "বুড়ো হলো হাতির মতো। হাতি যেমন নিজেকে জানেনা যে নিজে কতটা বড় তেমনি বুড়োও জানেনা ও কতটা প্রতিভাবান অভিনেতা"... একাধিক বার বলেছেন "অভিনয়ের জায়গায় আমি কাউকে ভয় পাই না সাবু (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) আর বুড়ো ছাড়া। কোন সময় যে অভিনয়ের প্যাঁচে আমাকে হারিয়ে দেবে বুঝেই উঠতে পারব না"... এই "বুড়ো"র আসল নাম? বিখ্যাত অভিনেতা তরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়, মহানায়ক উত্তম কুমারের আদরের ছোট ভাই।
তাঁর জন্ম ১৯৩১-এ, কলকাতায়। অভিনয়ের শখ ছোট থেকেই। পাড়ায় শখের থিয়েটারে অভিনয় করেছেন চুটিয়ে। প্রথম অভিনীত নাটকের নাম "সাজাহান"। ভবানীপুরের সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর আশুতোষ কলেজে ভর্তি হন তিনি।
কিন্তু অভিনয়ের ভূত যে তখন মাথায় ভালো মতো চেপে বসেছে। তাই কলেজের পড়া শেষ না করেই পুরোদস্তুর অভিনয়ে মন দিলেন। কিছুদিন চাকরিও করেছিলেন কিন্তু তারপর সেসব ছেড়ে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন তরুণ কুমার।
প্রথম অভিনীত ছবির নাম 'হ্রদ'। তখনো তাঁর দাদা কিন্তু "উত্তম কুমার" হয়ে ওঠেননি। লড়াই চালিয়ে গেছেন দুই ভাই একসঙ্গে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকেন। তবে নায়ক হিসেবে নয়, চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই তাঁকে আমরা বেশিরভাগ ছবিতে অভিনয় করতে দেখেছি এবং তাঁর অতুলনীয় অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি। দাদার অতি স্নেহের পাত্র ছিলেন তিনি।
কিন্তু কোনো ছবিতে দাদা উত্তমের অভিনয় পছন্দ না হলে তাঁর অভিনয়ের সমালোচনা করতেও ছাড়তেন না ভাই "বুড়ো"। আবার ভাল লাগলে গিয়ে দাদাকে প্রণাম করে জানাতেনও সে কথা। উত্তম কুমার মহানায়ক, কিন্তু তরুণ কুমারও বিরাট মাপের অভিনেতা। উত্তমকুমার জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার আগেই কিন্তু তরুণ কুমার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন "দাদাঠাকুর" ছবিতে অভিনয়ের জন্য। বহু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
তাঁর অভিনয় নিয়ে একটি মজার ঘটনা জানানো যাক। "সন্ন্যাসী রাজা" ছবিতে উত্তম কুমার তরুণ কুমার দুই ভাইই অভিনয় করেছিলেন। ঐ ছবির 'কাহারবা নয় দাদরা বাজাও'...এই গানের শুটিং চলছে। সেই দৃশ্যে উত্তম গানে লিপ দিচ্ছেন। পাশে হুঁকো খাচ্ছেন তরুণ কুমার ও বাকি চরিত্ররা। শুটিং চলাকালীনই গানের মাঝখানে একবার হুঁকোর পাইপ মুখে ঢোকাতে গিয়ে তরুণ কুমার পাইপটা ভুল করে নাকে ঢুকিয়ে ফেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে পাইপটা বার করে নিয়ে মজার একটা মুখ ভঙ্গিমা করে ভুলটা ম্যানেজ করে নিলেন তরুণকুমার। এই সময় ক্যামেরায় তরুণ কুমারকেই ক্লোজ শটে নেওয়া হচ্ছিল। উত্তম গান না থামিয়ে চালিয়েই গেলেন। ডিরেক্টর "কাট" বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। এবং পরে দেখা গেল যে পুরো গানের মধ্যে ওই শটটাই সেরা। উত্তম কুমার ওই দৃশ্য দেখে গানের মধ্যেই হেসে ফেলেন। এই ঘটনার পরই উত্তম কুমার তাঁর ভাইয়ের প্রতিভাকে হাতির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
সিনেমার পাশাপাশি পেশাদার মঞ্চেও চুটিয়ে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনীত "নহবত" নাটকটি টানা সাত বছর ধরে চলেছিল। বহু ছবিতে উত্তমের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তিনি যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঝিন্দের বন্দী, দেয়া নেয়া, জীবন মৃত্যু, মন নিয়ে, সন্ন্যাসী রাজা... মহানায়ক দাদার উজ্জ্বলতা কিন্তু ম্লান করে দিতে পারে নি তাঁর অভিনয়ের দীপ্তি। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি আজও আমাদের হাসি কান্নার দোলায় দুলিয়ে দিয়ে যায়।