শমিত ভঞ্জ: এক অনন্য অভিনেতা

"বুবু আমার বিশেষ পরিচিত।...তপন বাবুর হাটে বাজারে ছবিতে শুটিং করতে করতেই ওর সঙ্গে আলাপ...।... মেদিনীপুর থেকে এসেছে, স্ট্রাগলিং অ্যাসপায়ারিং অভিনেতা কিন্তু কলকাতা শহরে থাকার মতো ভাল জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি বললাম আমার বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরে থাকতে পারে যদি আপত্তি না থাকে।... বুবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। ও একটা সরল স্বভাবের ছেলে। খেটে বড় হওয়ার ইচ্ছে, দেখতে সুন্দর, গানও জানে। সুতরাং স্বভাবতই নাম করতে পেরেছে। আমাকে খুবই শ্রদ্ধা করে।"
...ভানু সমগ্ৰ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই বুবু বা স্ট্রাগলিং অ্যাসপায়ারিং অভিনেতাটির ভালো নাম সমিত ভঞ্জ। বোহেমিয়ান, ক্ষ্যাপাটে, শুধু অভিনয়কে ভালোবেসে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে দেওয়া এক অনন্য অভিনেতা। এমন কথা মনে করা হয় যে অভিনেতা হিসেবে তাঁর তুলনা করা যেতে পারে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা ক্লিন্ট ইস্টুডের সঙ্গে। কিন্তু তিনি যে সময়ে বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে এসেছিলেন তখন বাংলা চলচ্চিত্র আকাশে সূর্য হয়ে বিরাজমান ছিলেন উত্তমকুমার। তাঁর পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও তখন বাঙালির মনে আলোড়ন তুলেছেন। তাঁদের অভিনয়ে, ক্যারিশমায় বাঙালি দর্শক থেকে পরিচালকরা পর্যন্ত বিভোর। সেই সময়ে অভিনয় জগতে প্রবেশ করলেন সমিত ভঞ্জ। তাই তার প্রতিষ্ঠা পেতেও একটু দেরি হয়। কিন্তু হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারে নি। সত্যিকারের যোদ্ধার মতো লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে প্রাপ্য সম্মান আদায় করেই ছেড়েছিলেন। জীবনের শেষ সিনেমা "আবার অরণ্যে"-তে যখন অভিনয় করেছিলেন তখন তিনি ক্যানসারের শেষ স্টেজে। কিন্তু তাই নিয়েই কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা, অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা।

প্রীতিময় ভঞ্জ এবং শীলা ভঞ্জের তৃতীয় পুত্র শমিতের জন্ম হয় ১৯৪৪ এর জানুয়ারি মাসে মেদিনীপুরের তমলুকে। তাঁর উপরে দুই দাদা এবং এক ছোট বোন ছিল। ছোটবেলা থেকেই খুব ডাকাবুকো স্বভাবের ছিলেন শমিত। শৈশবে একবার তাঁর ছোটবোন কৃষ্ণাকে এক সহপাঠী চড় মেরেছিল। তাতে রেগে গিয়ে সেই সহপাঠীকে বালির মধ্যে পুঁতে দিয়েছিল ছোট্ট শমিত। তার বয়স তখন সাত। শেষে শিক্ষকরা এসে তাকে উদ্ধার করেন। খেলতে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে... একমুঠো মাটি তুলে সেখানে ঘষে দিয়ে আবার খেলতে শুরু করেছে এমনই দুরন্তপনা ছিল তাঁর।

এহেন দুরন্ত দুঃসাহসিক স্বভাবের শমিত যে তপন সিংহের মতো পরিচালকের কাছ থেকে জোর করে কাজ আদায় করে নেবেন তাতে আর নতুন কি? তপন সিংহের মতো পরিচালক ও তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে সুযোগ দেন "আপনজন" ছবিতে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

একে একে নতুন ছবিতে সুযোগ পেতে থাকেন। অভিনয় করেছেন সত্যজিৎ রায় (অরণ্যের দিনরাত্রি), তরুণ মজুমদার(ফুলেশ্বরী, দাদার কীর্তি, গণদেবতা), বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (ফেরা) -এর মতো বিখ্যাত পরিচালকদের ছবিতে। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, স্বরূপ দত্তের পাশাপাশি শমিত ভঞ্জের নাম এবং খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বহু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন শমিত ভঞ্জ। শুধু বাংলা নয়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত বিখ্যাত ছবি "গুড্ডি"-তে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি।

বিখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ ছিলেন শমিতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ছবিতে অভিনয়ের খুব ইচ্ছে ছিল শমিত ভঞ্জের। সেই সুযোগ যখন এল তখন তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো ঘনিয়ে আসছিল। ডাক্তারও বারণ করেছিলেন। কিন্তু শমিত ভঞ্জ আনন্দে লাফিযয়ে উঠে বলেছিলেন "ফ্যান্টাস্টিক"... অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন "আবার অরণ্যে" ছবিতে। যদিও এই ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই মহাকালের ডাকে চিরদিনের জন্য এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অমৃতলোকে পাড়ি দিয়েছিলেন বাঙালির 'আপনজন' শমিত ভঞ্জ।


ঋণ: আত্মজীবনী - ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...