রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার অর্থাৎ আমাদের সবার প্রিয় অভিনেতা রবি ঘোষের অভিনয়জীবনের শুরুটা কিন্তু থিয়েটার থেকেই। থিয়েটার আর অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা থেকেই কলেজে পড়তে পড়তে বন্ধুদের নিয়ে একটা অ্যামেচার নাটকের দল গড়ে তুলেছিলেন তিনি। তারপর অভিনয়সূত্রে উৎপল দত্তের সাথে যোগাযোগ হল। উৎপল দত্ত তখন সবে নিজস্ব নাটকের দল 'পি এল টি' গড়তে শুরু করেছেন।রবি এই গড়ার কাজে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। হলেন সহযাত্রী। একে একে 'অঙ্গার'-এর মতো অনেক বিখ্যাত নাটকে অত্যন্ত সুখ্যাতির সঙ্গে অভিনয় করলেন। তারপর একদিন কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গী করে রবি ঘোষও নিজের একটি নাটকের দল তৈরি করলেন। দলের নাম দিলেন, 'চলাচল'।
সিনেমার জগতে রবি ঘোষের আত্মপ্রকাশ প্রখ্যাত পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে 'কিছুক্ষণ' ছবির মধ্য দিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই ছবিটির প্রিন্ট ও নেগেটিভ সব নষ্ট হয়ে গেছে। যাই হোক, 'কিছুক্ষণ'-এ আত্মপ্রকাশ হলেও সত্যজিৎ রায়ের 'অভিযান'- ছবিতে পেলেন প্রতিষ্ঠা। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় সকলের মন কাড়ল, চিত্রসমালোচকদের প্রভূত প্রশংসা পেল। হয়ে উঠলেন সত্যজিৎ-এর অন্যতম প্রিয় অভিনেতা।
অসাধারণ অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে মুখ্যচরিত্রে রেখে 'পরশপাথর' ছবিটি যেমন সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন, তেমনি রবি ঘোষকে মুখ্যচরিত্রে রেখে 'গল্প হলেও সত্যি' ছবিটি পরিচালনা করলেন তপন সিনহা। এতে তিনি রবি ঘোষকে দিয়ে প্রথমবার প্লেব্যাকও করালেন। ছবিটি শুধু জনপ্রিয়ই হল না, শিল্পভাবনায় কালজয়ী বলেও চিহ্নিত হল এবং প্রমাণ করল রবি ঘোষ এতটাই শক্তিশালী এক অভিনেতা, যিনি সুযোগ পেলে একাই একটা ছবি টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
সাধারণের কাছে রবি ঘোষের পরিচয় কৌতুক-অভিনেতা হিসেবেই বেশি, কিন্তু আসলেই তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা। তাই সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন চরিত্রাভিনেতা, ঐ যে 'অরন্যের দিনরাত্রি' ছবিতে সত্যজিৎ শুভেন্দুর মুখে সংলাপ লিখেছিলেন, 'শেখর না হলে যেন জমে না'--এ-যেন সত্যজিৎ এর নিজের কথা রবি সম্পর্কে, 'রবি না হলে ছবি জমে না'।
সত্যজিতের বিভিন্ন ছবিতে নানান ধরণের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ যেমন পেয়েছেন, তেমনই সেই চরিত্রগুলো নিজের অনবদ্য অভিনয় দিয়ে সার্থক তো বটেই, অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন রবি ঘোষ। যেমন, 'অরন্যের দিনরাত্রি'-ছবিতে সেই কুয়োতলায় স্নান করার দৃশ্যটার কথাই ভাবুন, শর্টস পরে সাবান মেখে শর্মিলা ও কাবেরী বসুর কাছে হঠাৎ স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা কী সাবলীল ভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন!
'গুপি গাইন বাঘা বাইন'-সিরিজে তাঁর অভিনয় তো ক্লাসিক। এই ছবিগুলোতে তাঁর চরিত্রে কমেডি ছিল ঠিকই, স্ল্যাপস্টিক ছিল ঠিকই, কিন্তু তা কখনই জলো হয়ে ওঠেনি সত্যজিতের মুন্সিয়ানা ও তাঁর অভিনয়ের জোরের জন্যই। তাতে নানারকম সেডস এনেছেন তিনি তাঁর অভিনয় দিয়ে এবং তাঁর অভিনয়গুণে তা হয়ে উঠেছে ক্লাসিক সিরিও কমিক। তাঁর অভিনয় এতটাই 'নিজস্ব' ছিল যে, দেশ ও বিদেশের কারও সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে না; তাঁর তুলনা তিনিই।