হাসিকান্নার আলোছায়ায় অভিনেতা নৃপতি চট্টোপাধ্যায়

সারা জীবনে প্রায় সাড়ে চারশো ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি, সবই বাংলা; কিন্তু নিজের অভিনীত ছবির একটিও কোনদিন দেখেননি। হ্যাঁ, এমনই একজন অভিনেতা ছিলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়।

সিনেমায় আসার আগে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের ছেলে নৃপতি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি যে, অভিনয় করবেন। আসলে তিনি ভবঘুরে হতে চেয়েছিলেন। ছোট থেকেই দুমদাম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন দেশ চষতে। তেমন করে বেরিয়েই একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন কলকাতায়।

কলকাতার পথে পথে ফুটপাথরের ওপর ছাউনি ছুঁয়ে উনুন জ্বলে, ভাতের গন্ধ ওঠে, মানুষ খায়, মানুষী খায়, শিশুরা খেলে। তাদের মধ্যেই হয়তো নৃপতির কেটে যেত বেশ কিছু বোহেমিয়ান দিন। কিন্তু, বিধি বাধ সাধল। পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তিনি নৃপতিকে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়।

রসালো আত্মীয়ের আতিথ্য পেয়ে নৃপতির বেশ ভালোই লাগল। ভাবলেন, ক'দিন বেশ রসেবশে থাকা যাবে। কিন্তু, আত্মীয়টি মনে মনে ফাঁদলেন ভবঘুরে নৃপতিকে থিতু করার ফন্দি। 

সুতরাং, শ্যুটিং দেখানোর নাম করে একদিন নিয়ে গিয়ে তুললেন একেবারে সেকালের নামকরা পরিচালক সুশীল মজুমদারের কাছে। কারণ, সুশীলবাবু তাঁর বন্ধু মানুষ।

NripatiChattopadhyay1

আত্মীয়টি সুশীলবাবুকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন। বললেন, যেমন করেই হোক নৃপতির একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে!

নৃপতি এবার কলকাঠিটি বুঝলেন। মনে মনে হাসলেন, শ্যুটিং-ই বটে! অন্যসময় হলে নৃপতি ফাঁকতাল বুঝে ঝাঁপতাল দিয়ে পালাতেন। এবার কী জানি মনে কী হল, ভাবলেন, দেখিই না কী হয়!  


ওদিকে আত্মীয়ের আবদারে সুশীলবাবু বলে বসলেন, বেশ। 


তারপরই নৃপতির দিকে ফিরে শুরু হল জেরা। জিজ্ঞেস করলেন, অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আছে? নাটকে বা মঞ্চে?


আজ্ঞে, না।


ফিলিম-টিলিম দেখা হয়?


আজ্ঞে, তেমন না।


পড়াশুনো?


আজ্ঞে, ইস্কুল ঠেঙিয়ে তার ওপারে আর এগোয়নি।


সুশীলবাবু অসহায়ভাবে একবার আত্মীয়ের দিকে তাকালেন। আত্মীয় একটু লজ্জিত, কিন্তু চোখে-মুখে আকুতির অভাব নেই। তাই দেখে কথা ফেরাতে পারলেন না সুশীলবাবু। নৃপতিকে এমন কিছু করে দেখাতে বললেন, যাতে লোকে বেশ মজা পায়।

সুযোগ পেতেই নৃপতি দেখিয়ে দিলেন কেরামতি, যাতে তিনি আবাল্য সিদ্ধহস্ত। না অভিনয় দিয়ে নয়, অঙ্গভঙ্গি করে এমন গুলবাজি শুরু করলেন যে, অফিসের উপস্থিত সকলেই তাতে একেবারে হেসে লুটোপুটি খেয়ে পেটে খিল ধরিয়ে ফেললেন। 

তাই দেখে সুশীলবাবু বুঝলেন যে, নৃপতির হবে। ফলে, তিনি নৃপতিকে এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টার কাম এক্টরের চাকরি দিয়ে দিলেন। বললেন, থাকুক-দেখুক-শিখুক, ওতেই হবে।

হ্যাঁ ওতেই হল। দেখতে দেখতেই অভিনয় শিখে ফেললেন নৃপতি। ১৯৩৬ সালে ডিজি অর্থাৎ সেকালের আর এক বিখ্যাত পরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ছায়াছবিতে প্রথম অভিনয়ও করে ফেললেন। তখন নৃপতির বয়স ঊনত্রিশ বছর। ছবির নাম, 'দ্বীপান্তর'। 

পরের বছর খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করলেন।  ছবির নাম, 'তটিনীর বিচার'। পরিচালক, সুশীল মজুমদার। ছবি বেশ দারুণ চলল হলে।

সুতরাং, আর নৃপতিকে পায় কে! অভিনয় করে যেতে লাগলেন একটার পর একটা ছবিতে। খলনায়ক থেকে ক্রমশ হয়ে উঠলেন হাস্যরসের অভিনেতা। বাংলা সিনেমা জগতের সঙ্গে এভাবেই অভিনয়কে ভালোবেসে নৃপতি এমনভাবে জুড়ে গেলেন যে, তাঁর আর বাউণ্ডুলে হওয়া হল না।

দিন কাটতে লাগল। নানা রঙের দিন। তারই মধ্যে ধীরে ধীরে একদিন স্টুডিও-সিস্টেম বাংলা ছায়াছবির জগতে শেষ হয়ে গেল। গেল মাস মাইনের চাকরির দিন। এল কাজ পেলে টাকা পাওয়ার দিন, না কাজ করলে না-খাওয়ার দিন।

তখন ছয়ের দশক শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। হাস্যরসের শিল্পী নৃপতি চট্টপাধ্যায়ের শুরু হয়েছে অভাবের দিন। হাতে তেমন কাজ নেই। যেটুকু কাজ পান, তাতে দক্ষিণাও তেমন আর জোটে না। 

যে সময়ের কথা বলছি, সে-সময় কৌতুক-অভিনেতারা বাংলা ছায়াছবিতে ছিলেন একান্ত অপরিহার্য, তাঁরা না-হলে ছবি জমতই না। কিন্তু, যে পারিশ্রমিক তাঁদের দেওয়া হত, তাতে ভালো করে সংসারও চলত না। 

NripatiChattopadhyay2


নৃপতি অবশ্য অকৃতদার। তবু, এই সময় তাঁর একারও দিন চলা দায় হয়ে উঠল।


এমন পরিস্থিতিতে একদিন নৃপতি শুনলেন যে, পরিচালক সত্যজিৎ রায় 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' ছবি করছেন। এই তো বছর দুই আগেই ওঁর 'চিড়িয়াখানা' ছবিতে নৃপতি অভিনয় করেছেন। অভিনেতা হিসেবে মানিকবাবু তাঁকে বেশ পছন্দ করেন। 

কিন্তু, মানিকবাবু হলেন সেই পরিচালক, যাঁরা চরিত্র-অনুযায়ী অভিনেতা খোঁজেন; অভিনেতার জন্য চরিত্র তৈরি করেন না। তাই নতুন ছবিতে কোন চরিত্রের জন্য নৃপতিকে প্রয়োজন মনে হলে, নৃপতিকেই ডাকতেন; ডাকেননি মানে, প্রয়োজন নেই। তবু একবার গিয়ে তদ্বির করতে দোষ কী!

নৃপতি কোন উপায় না-দেখে প্রায় মরিয়া হয়েই গেলেন সত্যজিতের কাছে। বললেন, মানিকবাবু, আপনি ছবি করছেন শুনলাম...আমাকে একটা পার্ট দিন না!

এই চাওয়ার মধ্যে এমন একটা আর্তি ছিল, যাতে অনুভূতিপ্রবণ সত্যজিৎ সহজেই বুঝলেন মানুষটা কোন্ তাড়নায় ছুটে এসেছেন। কিন্তু, এই মুহূর্তে তিনি বড্ড অসহায়। ইতিমধ্যেই সবাইকে পার্ট দেওয়া হয়ে গেছে যে! আর তো উপায় নেই! 

 

নৃপতি অনুনয় করলেন, তবু দেখুন না, যদি কিছু বেরোয়, আমার যা অবস্থা, তাতে মৃত সৈনিকের পার্ট পেলেও বর্তে যাই! 

তখন সত্যজিৎ একটু ভেবে বললেন, বেশ, আপনি আমার ছবিতে কাজ করছেন। 

দু'চোখে অসীম কৃতজ্ঞতা রেখে নৃপতি বিদায় নিলেন। সত্যজিৎ দরজা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে বিদায় দিলেন।

 

'গুপি গাইন বাঘা বাইন' ছবিতে গুপি আর বাঘা যখন রাজার কারাগারে ভুতের বরে ভালো ভালো খাবার খাচ্ছে, তখন যে হাড় জিরজিরে বুভুক্ষু বুড়োরক্ষীটি লোলুপ চোখে সেই খাবারের দিকে চেয়েছিল, শেষে গুপিবাঘার ফেলে যাওয়া খাবার গোগ্রাসে খেতে বসেছিল; সেই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়।

কোন সংলাপ ছিল না, পুরো ছবিতে একটি দৃশ্য ছাড়া আর কোথাও কোন উপস্থিতি ছিল না, তবু সেই ক্ষণিকের উপস্থিতিটুকুই জীবনের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে স্মরণীয় করে তুলেছিলেন নৃপতি। বড় শিল্পী না-হলে এটা সম্ভব হত না।

অভিনয়ের জন্য কোনদিন কোন পুরস্কার পাননি নৃপতি। দারিদ্র ও নিঃসঙ্গতামাখা শেষ দিনগুলোতেও এ-নিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ ছিল না। বরং বলতেন, "সবাই কষ্টের মধ্যে থাকে, হাসবে কি করে? আমি সেই বিষণ্ণ মুখে হাসি ফোটাই-এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কি থাকতে পারে?" এমন কথা তো তাঁকেই মানায়, সেই বাউণ্ডুলে যুবকটি; সংসার আর অভাবের ঊর্ধে উঠে যিনি অনেক অনেক বড় শিল্পী হতে পেরেছিলেন...

ঋণ স্বীকার : সত্যজিৎ ও নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের গল্পটি শ্রদ্ধেয় অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক শ্রী পঙ্কজ মুন্সীর কাছ থেকে পেয়েছি। অন্যান্য তথ্যাবলীর জন্য গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের লেখা 'সোনার দাগ' বইটির কাছে ঋণী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...