‘দ্যাখরে ভারতবাসী কেমন
উল্টে দিয়েছি গীতা,
রামের কোলে সৌদামিনী
শ্যামের কোলে সীতা।’
ছড়াটি অভিনেতা অশোককুমারের লেখা। এ-ধরনের অনেক ছড়া তিনি লিখেছিলেন। তাতে পৌরাণিক চরিত্রকে এর ঘাড়ে তার কোলে তুলে দিয়ে অদ্ভুত এক রকমের মজা করেছিলেন। যেভাবে এখানে রামের স্ত্রী সীতা এবং শ্যামের অনেক স্ত্রীর মধ্যে এক স্ত্রী সৌদামিনীর অদলবদল ঘটিয়েছেন, তেমনি করে। নাম বদলের শ্যাম বদল তাঁর জীবনেও কম ঘটেনি। সে-কথাই এবার বলি।
অশোককুমারের তিনটি নাম। ‘অশোককুমার গাঙ্গুলি’, ‘কুমুদলাল গাঙ্গুলি’ এবং ‘দাদামনি’। অনেকেই মনে করেন যে, ‘অশোককুমার’ তাঁর ফিল্মি নাম, আসল এবং আদি নাম ‘কুমুদলাল’। ব্যাপারটা মোটেই কিন্তু তা নয়। এই নামাবলির ভেতরে অনেক গল্প আছে।
অশোককুমারের মামা-দাদু মাখনলাল চতুর্বেদী ছিলেন ভাগলপুরের খুব ধনী লোক। মেয়ে সন্তানসম্ভবা হতেই তাঁকে এনে রাখলেন নিজের কাছে। তখন তো আর পরীক্ষা করে বোঝার উপায় ছিল না যে, ছেলে হতে চলেছে, না মেয়ে; তবু ভদ্রলোক কী-জানি-কেন নিশ্চিত হয়ে ভেবে বসলেন যে, নাতিই আসতে চলেছে ঘরে! ব্যস, উৎসাহের চোটে শুরু হয়ে গেল সেই সম্ভাব্য নাতির জন্য দোলনা ও খেলনা কেনার ধুম। নামও রেখে ফেললেন, ‘অশোককুমার’। শুধু তাই নয়, খোদ ইংল্যান্ড থেকে ঘটা করে হবু নাতির পোশাক আনাতে অর্ডার দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করলেন। সেই ঘটা দেখে আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ আর থাকতে পারলেন না, তাঁরা বললেন যে, নাতিই যে হবে, তার তো স্থির নিশ্চয়তা নেই; নাতনিও তো জন্ম নিতে পারে! খেলনা-দোলনা নিয়ে না-হয় সে খেলাধুলো করল, ঠিক আছে; কিন্তু ছেলেদের পোশাক আনালে মেয়ে হলে পরবে কেমন করে! এই যুক্তিটা মাখনলালের একেবারেই অযৌক্তিক মনে হল না। তবে কি না তিনি বড়লোক মানুষ, শখ-আহ্লাদে কামাই করা তাঁর স্বভাব নয়। তাই খেয়াল যখন হয়েছে, পোশাকের অর্ডার তিনি দিলেনই; তবে এমন পোশাকের অর্ডার দিলেন, যেটা ছেলে বা মেয়ে উভয়েই পরতে পারে। অর্ডার দেওয়ার মাসখানেক পরে সাগরপারের জাহাজে চেপে হাজির হল এক বিশাল পার্সেল। তখনও অশোকের জন্ম হয়নি। তবু পার্সেলের ঠিকানায় জ্বল জ্বল করছে তাঁরই নাম—‘অশোককুমার গাঙ্গুলি, কেয়ার অব, মাখনলাল চতুর্বেদী’। এভাবে জন্মের আগেই অশোকের নাম একেবারে পাকা হয়ে গেল এবং তাতে পড়ে গেল সাগরপারের সিলমোহর। তাই যদি হল, তাহলে তিনি ‘কুমুদলাল’ হলেন কখন? বলছি।
অশোকের বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি ছিলেন ডাকসাইডে উকিল। অশোক তখন সদ্যযুবক, কিশোর এবং অনুপ—এ দু’জন নেহাতই নাবালক। বয়সে বড় হলেও ছোটভাইদের সঙ্গে অশোক শিশুর মতোই মিশতেন। খুনসুটি করতেন। তো, একদিন কুঞ্জলাল একটি পাঞ্চিং মেশিনের অর্ডার দিলেন। সেটি বাড়িতে এল পার্সেলে। পার্সেলের গায়ে ঠিকানার ওপর নামের জায়গায় লেখা, সংক্ষেপে, ‘কে. গাঙ্গুলি’। পার্সেলটি কুঞ্জলালের হাতে পড়ার আগেই পড়ল তিন ভাইয়ের হতে। মেশিনটি দেখে, তার ওপর প্রত্যেকেরই খুব লোভ হল। তাই সেটি কে নেবেন, তাই নিয়েই কাড়াকড়ি পড়ে গেল। কিশোর খুব বুদ্ধিমান, তিনি বুদ্ধি করে বললেন যে, তাঁর নাম ‘কে’ দিয়ে শুরু, কাজেই পার্সেলের ‘কে’ তাঁরই নাম। সুতরাং, মেশিনটি তাঁর। ওদিকে অনুপও কম যান না। তাঁর ‘কে’ দিয়ে একটি ডাক নাম ছিল; তিনি সেটিকেই জাহির করে মেসিনের দাবিদার হয়ে বসলেন। মুশকিলে পড়লেন অশোক, তাঁর ‘কে’ দিয়ে কোন নাম ছিল না; ফলে, তাঁর মনখারাপ হয়ে গেল। ততক্ষণে আসরে নেমে পড়েছেন কুঞ্জলাল। তিনি বেশ আমুদে এবং রসিক লোক। তিনি বললেন যে, অশোকের ‘কে’ দিয়ে নাম নেই কেন, নিশ্চয় আছে! অমনি একখানা নাম বানিয়ে দিলেন। বললেন, অশোক হচ্ছেন কুঞ্জলালের ছেলে ‘কুমুদলাল’। এভাবেই ‘কে’ অক্ষরের নামে সব ছেলেকে বেঁধে ফেললেন কুঞ্জলাল। অশোকের মনখারাপ ঠিক করে ফেললেন। এবং, মেশিনটির মালিকানা অকাতরে সবার মধ্যে বিলিয়ে সকলকেই খুশ করে দিলেন। শুধু তাই নয় নিজের সঙ্গে লালে লাল মিলিয়ে অশোকের যে নতুন নামটি তিনি দিলেন, সেটি মনে মনে এতই পছন্দ হয়ে গেল যে, সেটিকেই সরকারি করে ফেললেন। ব্যস, এভাবেই অশোককুমার গাঙ্গুলি হয়ে উঠলেন, ‘কুমুদলাল গাঙ্গুলি’।
অশোককে ‘দাদামনি’ বলে ডাকতেন ছোট বোন, সতীরানি। তাই শুনে শুনে কিশোর, অনুপ সকলেই তাঁকে এই নামে ডাকতেন ছোট থেকে। বম্বে টকিজের ম্যানেজার শশধর মুখার্জির সঙ্গে যখন বিয়ে হল, তখন তিনিও অশোককে ‘দাদামনি’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। অশোক যখন বম্বে টকিজে যোগ দিলেন, তখন সেখানকার আর্টিস্ট ও কলাকুশলীরাও শশধরের সম্বোধনেই তাঁকে ‘দাদামনি’ বলতে লাগলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে তিনি পুরো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কাছেই ‘দাদামনি’ হয়ে উঠলেন একদিন। হ্যাঁ এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসে ঘরের ‘দাদামনি’ যেমন সকলের হয়ে উঠলেন, তেমনি চেনামহলের ‘কুমুদলাল’ আবার সকলের ‘অশোককুমার’ হয়ে উঠলেন। কীভাবে? সেটাই বলছি।
কলকাতায় ল পড়তে এসেছিলেন অশোককুমার। কিন্তু, তাঁর আসল আগ্রহ ফটোগ্রাফিতে। তাই শুরু হল কলকাতার স্টুডিগুলোতে ঘোরাফেরা। কিছুদিনের মধ্যেই শুনলেন বম্বে টকিজের হিমাংশু রাই জার্মানি থেকে খুব ভালো ক্যামেরা আনিয়েছেন এবং ফটোগ্রাফির অনেক নতুন মেথড শিখে এসেছেন। মনে হল, এসব তো শিখতেই হবে। যেই মনে হল, ব্যস, অমনি কলকাতা ছেড়ে সোজা বম্বে। ভগ্নীপতিকে ধরে ঢুকে পড়লেন একেবারে হিমাংশু রাইয়ের উইনিটে। ল্যাব-এসিস্ট্যান্ট হিসেবে। কাজকর্ম সব ভালোই চলছিল। তার মধ্যেই ঘটে গেল এক ঘটনা, যেটা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল একেবারেই।
তখন হিমাংশু রাই ছবি করছিলেন, ‘জীবন নাইয়া’। শ্যুটিং সবে শুরু হয়েছে একদিন বা দু’দিন। তারই মধ্যে ছবির হিরো সেট থেকে কাউকে কিছু না-বলে লুকিয়ে পালিয়ে গেল। খোঁজ খোঁজ খোঁজ! চাদ্দিকে শোরগোল পড়ে গেল। কিন্তু, সেই হিরোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন ভদ্রঘরের শিক্ষিত-সুদর্শন ছেলেরা চট করে সিনেমায় আসতে চাইত না। সিনেমাজগৎ ও অভিনয়জীবন সম্পর্কে তাদের এবং তাদের পরিবারের একটি নেতিবাচক মনোভঙ্গি ছিল। ফলে, চালু-শ্যুটিংয়ের মধ্যে হিরো কোথায় পাওয়া যায়!—এই দুর্ভাবনায় যখন হিমাংশু ক্লিষ্ট, তখন তাঁর চোখ গেল অশোকের দিকে। বাহ, বেশ সুদর্শন তো ছেলেটি! এর কথা আগে কেন মনে হয়নি! ব্যস, অমনি ঠিক করে ফেললেন অশোকই হবেন তাঁর ছবির হিরো। প্রস্তাব শুনে আকাশ ভেঙে পড়ল অশোকের মাথায়। তিনি রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে। উকিলহিসেবে বাবার খুব নাম, খুব সম্মান। ‘তাঁর ছেলে’ সিনেমায় অভিনয় করছে লোকে জানলে, তাঁর সেই নাম-সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে! হিমাংশুর কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করলেন, কিন্তু, কে শোনে কার কথা! হিমাংশু তাঁকে মেকআপ করিয়ে হাতেপাঁজি একেবারে হিরো বানিয়ে ফেললেন। শুরু হয়ে গেল অশোকের অভিনয়জীবন। হিরো হলেন, সেটা ঠেকাতে পারলেন না। তবে, বাবার মানসম্মান বজায় রাখতে শেষ চেষ্টা হিসেবে সিনেমার পর্দায় সরকারি নাম ‘কুমুদলাল’ আসতে দিলেন না, তার বদলে এল তাঁর পুরনো নাম, ‘অশোককুমার’। তখন কে জানত, এই নামেই তিনি ভারত থেকে জগৎবিখ্যাত হয়ে উঠবেন! যাই হোক, এই হল তাঁর ‘অশোককুমার’ থেকে ‘কুমুদলাল’ এবং ‘কুমুদলাল’ থেকে ‘অশোককুমার’ হয়ে ওঠার গল্প।