নীহারিকা দেবীকে চেনেন? চেনেন না? চেনেন চেনেন, নামে না-চিনলেও মানুষটিকে তো চেনেন অবশ্যই। আমাদের সুপরিচিত 'বেদে', 'প্রথম কদম ফুল', 'যতনবিবি'-র স্রষ্টা সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত'ই আসলে, নীহারিকা দেবী। প্রথম সাহিত্যজীবনের ছদ্মনাম। গত শতকের দুইয়ের দশকে যে-সব পত্রিকায় সদ্যলেখকের লেখা বেরুলে লেখকের অহংকার করা সাজত, লেখকের খানিক জাতে উঠবার সাধ পূরণ হত; তেমনই হাতে গোনা কিছু পত্রিকার মধ্যে একটি ছিল, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত "প্রবাসী"। অচিন্ত্য তখন দস্তুরমতো কবি। কবিতা এনতার লিখছেন, পাঠাচ্ছেন 'প্রবাসী'-তে, কিন্তু পাত্তা পাচ্ছেন না কিছুতেই। বছর আঠেরোর কলেজ পড়ুয়া ছেলে, কাজেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধির অভাব হল না। শুনেছেন, পত্রিকাওয়ালারা নাকি মেয়েদের লেখা পেলেই হ্যাংলার মতো হুমড়ি খেয়ে ছাপতে পাঠিয়ে দেন। ছেলে হয়ে তো কিছু হল না, এবার মেয়ে সেজেই দেখা যাক না, ব্যাপারটার জল কদ্দুরে গিয়ে দাঁড়ায়! ব্যস, নীহারিকা দেবী'র নামে তাঁর আগের পাঠানো অথচ পছন্দ না-হওয়ায় ফেরৎ আসা একটি কবিতাই কপাল ঠুকে ফের পাঠিয়ে দিলেন। এবার আর দেখতে হল না। নিন্দুকের রটনা সত্যি করে 'প্রবাসী'-তে তা প্রকাশ পেয়ে গেল! তাঁর লেখা নামকরা পত্রিকায় প্রকাশিত হল, তার জন্য খুব আনন্দও হল। কিন্তু, সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। মনের মধ্যে একটা কথাই বাজতে লাগল : লেখা প্রকাশিত তো হল, কিন্তু, কই তাঁর সত্যিকারের নাম তো প্রচারিত হল না। আর তখনই ছদ্মনামটাকে বড্ড পর পর বোধ হতে লাগল। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো কবিতাটা জনপ্রিয়ও হয়ে গেল, এবং নীহারিকা দেবীর কাছে বিভিন্ন পত্রিকার তরফ থেকে কবিতা পাঠানোর আবদার আসতে লাগল। এবার, কেমন লাগে বলুন তো! অচিন্ত্য আর সহ্য করতে পারলেন না। দূর ছাই বলে নীহারিকা দেবীকে বিসর্জন দিয়ে অচিন্ত্যর আত্মপ্রকাশে এবার উঠেপড়ে লাগলেন। এবং, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে 'প্রবাসী'-র পাতায় স্বনামে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পেলেন। গল্পলেখক হিসেবে বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্রও স্বনামে আত্মপ্রকাশ করলেন এর বছর তিনেক পরে, 'প্রবাসী'-র পাতাতেই, 'শুধু কেরাণী' গল্পের মধ্য দিয়ে। ফলে, দুই বন্ধুর আত্মপ্রকাশের পটভূমিতে জাজ্বল্যমান হল একটাই পত্রিকা, 'প্রবাসী'।
এই আত্মপ্রকাশের সলতেপাকানো পর্বে যাঁর অবদান অবশ্যই স্মরণীয়, তিনি হলেন রণেন গুপ্ত। অচিন্ত্য ও প্রেমেন্দ্র তাঁরই স্কুলের দুই বন্ধু। স্কুলের নাম, সাউথ সাবার্বান স্কুল। ফার্স্ট ক্লাসে পড়তে পড়তে অচিন্ত্য-প্রেমেনের বন্ধুত্বের শুরু। তখনই অচিন্ত্যর খাতা ভর্তি অজস্র কবিতায়। রণেন গুপ্ত খুব ভালো মানুষ, অসম্ভব ভালো পড়ান, সংস্কৃতের পণ্ডিত মশাই। ওঁর স্নেহ এবং প্রশ্রয় পেলেন অচিন্ত্য-প্রেমেন--দুজনেই। তার ওপর ভর করেই একদিন অচিন্ত্য তাঁর কবিতার খাতা তুলে দিলেন পণ্ডিত মশায়ের হাতে। আশীর্বাদের মতো সেই অভিজ্ঞতার কথা অচিন্ত্য 'কল্লোল যুগ' গ্রন্থে লিখতে গিয়ে বলেছেন : "তখনকার দিনে মেয়েদের গান গাওয়া বরদাস্ত হলেও নৃত্যকরা গর্হিত ছিল, তেমনি ছাত্রদের বেলায় গদ্যরচনা সহ্য হলেও কবিতা ছিল চরিত্রহানিকর। তা ছাড়া কবিতার বিষয়গুলিও খুব স্বর্গীয় ছিল না, যদিও একটা কবিতা "স্বর্গীয় প্রেম" নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু পণ্ডিত মশায়ের কি আশ্চর্য ঔদার্য! পঙ্গু ছন্দ, অপাংক্তেয় বিষয়, সংকুচিত কল্পনা--তবু যা একটু পড়েন, তাই বলেন চমৎকার। বলেন, 'লিখে যাও, থেমো না, নিশ্চিতরূপে অবস্থান করো। যা নিশ্চিতরূপে অবস্থান তারই নাম নিষ্ঠা।" অচিন্ত্য থামেননি, নিষ্ঠার অভাব ঘটতে দেননি কোনদিন। কবিতার খাতা পরে পণ্ডিত মশাই যদি বিরূপ হতেন বা শাস্তি দিতেন--তাহলে অচিন্ত্যকুমার সাহিত্যিক হয়ে ওঠার প্রেরণা পেতেন কিনা কে জানে! উলটে পণ্ডিত মশাই তাঁর ভেতরে যে নিষ্ঠ ও স্থিতধী হয়ে ওঠার মন্ত্র রোপণ করেছিলেন, অচিন্ত্য তাকেই লালন করেছেন সারাজীবন। জীবনের মূলধন করেছেন।
পণ্ডিত মশাই চেয়েছিলেন অচিন্ত্য ও প্রেমেন দুজনেই পরীক্ষায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল করুন। কবিতার কারিগর হয়েও দুই বন্ধু তাঁর মুখ রক্ষা করে ম্যাট্রিকে 'ভি' পেয়েছিলেন। দুই বন্ধুর প্রেক্ষাপট একই। দারিদ্র্য। আর্থিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রেমেন্দ্র পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। কিন্তু, অচিন্ত্য নানান পেশার জীবন যুদ্ধে পড়াশুনো চালিয়ে গেলেন দাঁতে দাঁত চেপে। হলেন বরেণ্য সাহিত্যিক, হলেন বিশিষ্ট জজ। সেখানেও পণ্ডিতমশায়ের নিষ্ঠার উপদেশ সমস্ত বাধা কাটিয়ে আত্মবিশ্বাসের কুলকুন্ডলিনী জাগিয়ে তাঁকে সার্থক করে তুলল।
শেষ কথায় এবার অন্যকথা। মুন্সিয়ানার দিক থেকে অচিন্ত্য ও সমরেশ বসুর মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায়, সেই বৈপরীত্যের সার্থকতা চট করে খুঁজে পাওয়া যায় না অন্য কারোর মধ্যে। সমরেশ যেমন একদিকে 'প্রজাপতি', 'বিবর'-এর মতো সার্থক অথচ নিন্দিত রচনার স্রষ্টা; আবার 'কালকূট' নামান্তরে তিনিই 'অমৃতকুম্ভের সন্ধানে', 'শাম্ব'-র মতো একেবারেই ভিন্নধারার রচনাতেও অনবদ্য। সেভাবেই অন্যদিকে অচিন্ত্যকুমারও 'বেদে', 'কাকজ্যোৎস্না', 'বিবাহের চেয়ে বড়' প্রভৃতি অশ্লীলতার ধুয়োয় নিন্দিত লেখা যেমন লিখেছেন; তেমনি 'পরম পুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ', 'পরমাপ্রকৃতি শ্রী শ্রী সারদামনি' প্রভৃতি ঐশীভাবের গ্রন্থরচনাতেও সমানভাবে সার্থক। তাঁর রচনারীতি সম্পর্কে 'এম সি সরকার এন্ড সন্স' প্রকাশনার কর্ণধার সুপ্রিয় সরকার 'প্রকাশকের ডায়েরি' গ্রন্থে লিখেছেন : "অচিন্ত্যকুমারের লেখায় ছিল গভীর কথা অতি সহজ সরল সুরে বলার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা। অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন তিনি। তাঁর লেখাতেও তার-ই প্রতিফলন। শুধুমাত্র ঝংকারিত শব্দশৈলীর ফুলঝুরির মধ্য দিয়ে যে সাহিত্য তিনি বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন, তার তুলনা মেলা ভার।"