বিজ্ঞান-তপস্বী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু

..."আমাদের মানুষ হইতে হইবে। দুঃখ ও দুঃখের কারণ নিবারণই ক্ষাত্র ধর্ম। পৃথিবী মানুষের দুঃখের রণক্ষেত্র, সে দুঃখের অংশ কে লইবে? গুরুভার বহন করিবে দুর্বল না সবল? প্রত্যেকে ক্ষত্রিয় হও। দৃঢ় ও শক্তিশালী হইতে হইবে। ভয়ের অতীত হইতে হইবে। সহস্র প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে হইবে। তবে এই দৈন্য দুর্দশা ঘুচিবে। জীবনীশক্তি মৃত্যুঞ্জয়ী হইবে।"...

উপরোক্ত কথাগুলি যিনি বলেছিলেন তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তিনি কোন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। হ্যাঁ, তাকে অবশ্যই সমাজ সংস্কারক বলা যেতে পারে।কিন্তু সবার আগে তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞান সাধক। তিনি বাংলা তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসু। স্বয়ং আইনস্টাইন যাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন...

“জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।”


বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্ৰহণ করেন । তাঁর বাবা ভগবান চন্দ্র বসু ইংরেজ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু ছেলেকে তিনি বাংলা মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া শেখান যাতে তাঁর সন্তান ভাল ভাবে বাংলা ভাষা শিখে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আগ্ৰহী হয়ে ওঠে। ১৮৭৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় সেখানকার ফাদার লাফোন্ট এর প্রভাবে তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মায়।

১৮৮৪ সালে জগদীশচন্দ্র বসু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি সম্পন্ন করে ভারতে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর বেতন ছিল তারই ইউরোপীয় সহকর্মীদের বেতনের অর্ধেকেরও কম। এ বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি টানা তিন বছর বেতন না নিয়েই পড়িয়েছিলেন। তাঁর এই প্রতিবাদে কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় তাঁকে ইউরোপীয় অধ্যাপকদের সমান বেতন দিতে। এই অবস্থাতেই তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান একটা ২৮ বর্গফুটের ছোট্ট ঘরে। তীব্র অর্থকষ্ট কিংবা উপকরণের অপর্যাপ্ততা কোন কিছুই তাঁকে তাঁর গবেষণা ও অধ্যবসায় থেকে বিরত রাখতে পারে নি।

স্থানীয় মিস্ত্রীদের শিখিয়ে পড়িয়ে তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করে নিতেন। বিনা তারে শব্দ প্রেরণের যন্ত্র "ক্রিস্ট্যাল রিসিভার", পরিবাহিতা পরিমাপক ট্রান্সপিরোগ্রাফ, চৌম্বক রেডিওমিটার প্রভৃতি তাঁর আবিস্কৃত উল্লেখযোগ্য মেশিন। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশচন্দ্র বসু যে সমস্ত গবেষণা করেছিলেন তার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনের বিখ্যাত রয়েল সোসাইটির সাময়িক পত্রে। এ সময় তাঁর গবেষণার মুখ্য বিষয় ছিল অতিক্ষুদ্র তরিৎচৌম্বক তরঙ্গ। রাডার, টেলিভিশন, মহাকাশযান প্রভৃতিতে তার ছাড়া যোগাযোগের জন্য যে তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়, নিজের তৈরি যন্ত্রের মাধ্যমে সেটির প্রথম সফল ব্যবহার করে দেখান তিনি ১৮৯৫ সালে। জগদীশ বসুর প্রায় সমসাময়িক ইতালীয় বিজ্ঞানী গুগলিয়েমো মার্কনি একই সময়ে বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গ ব্যবহার করে শব্দ তরঙ্গ পাঠাতে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু জগদীশ বসু তাঁর আবিষ্কারকে নিজের নামে পেটেন্ট না করায় বেতার আবিষ্কারের জন্য স্বীকৃত দাবিদার হন মার্কনি। জগদীশ চন্দ্র বসু কে বঞ্চিত করে মার্কনিকে এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু জগদীশ চন্দ্র ছিলেন প্রকৃত জ্ঞান সাধক... তিনি এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে একটি শব্দও করেন নি। পরবর্তি সময়ে মার্কনির পৌত্র স্বয়ং বলেছিলেন যে বৈদ্যুতিক চুম্বক তরঙ্গ ব্যবহার করে শব্দ তরঙ্গের প্রকৃত আবিষ্কারক জগদীশ চন্দ্রই।

জগদীশ চন্দ্র ছিলেন পৃথিবীর প্রথম জীবপদার্থ বিজ্ঞানী।উদ্ভিদেরও যে প্রাণ আছে, বিভিন্ন উদ্দীপনায় প্রাণীর মতই তারা সাড়া দেয় তা ও তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখান।গাছের বৃদ্ধি মাপার জন্য তিনি একটি সূক্ষ্ম যন্ত্র তৈরি করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল এটির বাংলা নাম দেন "বৃদ্ধিমান", কিন্তু পাছে সাহেবদের বিকৃত উচ্চারণে তা ‘বারডোয়ান’-এ পরিণত হয়, তাই এর নাম দিলেন "ক্রেস্কোগ্রাফ"।

জগদীশচন্দ্রের এই আবিষ্কার বিলেতের বিখ্যাত "পাঞ্চ" পত্রিকায় স্থান করে নেয়। তাদের প্রকাশিত একটি কার্টুনে দেখা যায়, এক জন ঘরে বসে তার যন্ত্রে সুর তুলছে, আর সুর শুনে উৎফুল্ল গাছেরা নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ছে। এটির একটি অনুকৃতি ১৯৫৮-র নভেম্বরে "জ্ঞান বিজ্ঞান" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

১৯০০-১৯০২ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল ইনস্টিটিউটে কাজ করেন।

১৯১৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের পর গবেষণার জন্য কলকাতায় জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠা করেন "বসু বিজ্ঞান মন্দির"। রয়্যাল সোসাইটি অব লন্ডন, ভিয়েনা একাডেমী অব সায়েন্স প্রভৃতি বিজ্ঞান সমিতির সম্মানিত সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯১৯ সালে গঠিত হওয়া "লীগ অব নেশন্স" -এর বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতা কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি নির্বাচিত হন।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্র বসু পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। জগদীশচন্দ্র ও তাঁর বন্ধু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জনক। ছোটদের জন্য "মুকুল" পত্রিকায় ১৩০২ বঙ্গাব্দ (১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ) আষাঢ় সংখ্যায় জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন দু’টি অসাধারণ নিবন্ধ "গাছের কথা" ও "উদ্ভিদের জন্ম মৃত্যু"। এর পর একই বিষয়ে লিখলেন "নির্বাক জীবন"। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ও গবেষণাধর্মী লেখাটি সহজ বাংলায় লেখা "আহত উদ্ভিদ", ১৩২৬-এর বৈশাখ সংখ্যা "প্রবাসী"তে প্রকাশিত হল। এই সবই জগদীশচন্দ্রের "অব্যক্ত" (প্রথম প্রকাশ আশ্বিন ১৩২৮) নামক প্রবন্ধ সঙ্কলনে পাওয়া যাবে। এই সমস্ত নিবন্ধে খুব পরিষ্কার ভাবে ‘উদ্ভিদের প্রাণ আছে’ - এ কথা আচার্য প্রমাণ করেছেন ও বলেছেন। এই প্রবন্ধেগুলির মূল বক্তব্য: উদ্ভিদের জন্ম, বৃদ্ধি, বংশবিস্তার, মৃত্যু, ভয়-ব্যথা-আনন্দ অনুভবের ক্ষমতা আছে, এমনকি অন্য উদ্ভিদ ও প্রাণের প্রতি সমব্যথী হওয়ার ক্ষমতাও আছে। এগুলিই প্রাণের লক্ষণ।

সুযোগের সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিবেশেও আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু যে জ্ঞানসাধনার দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন তা আজও আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

এই নিবন্ধ শেষ করি একটা তথ্য দিয়ে...দু'হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো - সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়েছিল ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।

বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় সপ্তম স্থানে আসেন বিজ্ঞানসাধক জগদীশ চন্দ্র বসু।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...