বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা বাংলা যখন উত্তাল, রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে আন্দোলনের সপক্ষে নিজের মতো করে প্রতিবাদ করছেন, জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন; সেই লগ্নে জন্ম হয়েছিল পঙ্কজকুমার মল্লিকের। তখন কে জানত যে, এই সদ্যজাত জন্মেছেন একেবারে রবীন্দ্রনাথের ভাবলোক আপন হৃদয়ে ধারণ করে!
আগের প্যারার শেষ কথাটা এখন একটু ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু, অজস্র ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনার কথা বললেই আশা করি বক্তব্যটি জলের মতো স্বচ্ছ হবেঃ
রবীন্দ্রনাথ তখনও ‘কবিগুরু’ বা ‘বিশ্বকবি’ অভিধায় খ্যাতিমান হননি। তিনি তখন আপামর শিক্ষিত-শ্রেণির কাছে নিছক শ্রদ্ধেয় কবি-সঙ্গীতকার-সাহিত্যিক, ‘রবিবাবু’। সে-সময় তাঁর গানও ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’ আখ্যায় আখ্যায়িত হয়নি; তাঁর গানের ডাকনাম তখন, ‘রবিবাবুর গান’।
তা, সেই রবিবাবুর গান তখন মধ্যবিত্ত শিক্ষিতমহল আপন অন্দর-মজলিশে বেশ গাইতে শুরু করেছে, আবার মোমের সিলিন্ডারে নিজের সুরে ঢেলে অনেকেই সেই গান রেকর্ড করতেও শুরু করেছেন। যদিও পঙ্কজ শুনেছেন সামান্যই; তবুও বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়ার পথে ওই অল্প শোনার ভালো লাগাতে তাঁরও ইচ্ছে জেগেছে ভালোভাবে রবিবাবুর গান শিখতে হবে।
ইচ্ছে জেগেছে বটে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তাঁর গানের গুরু দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নেহাতই পুরনোধাঁচের মানুষ, রবিবাবুর গান তেমন জানেন না। পঙ্কজকে নাগাড়ে শিখিয়ে চলেছেন নিধুবাবুর টপ্পা এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।
পঙ্কজ তখন কলেজে পড়েন। সে-সময় রবিবারের এক দুপুরে গেলেন গান শিখতে বউবাজারের মদন বড়াল লেনে দুর্গাদাসবাবুর বাড়িতে। বাড়িতে তখন দুর্গাদাসবাবু ছিলেন না। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ পঙ্কজের চোখে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গাথার একটি সংকলনগ্রন্থের ওপর। গ্রন্থটির নাম, 'চয়নিকা'। স্বভাব আগ্রহে সেটি টেনে নিলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে থেমে গেলেন একটি কবিতার ওপর। কবিতাটি এর আগে কখনও দেখেননি, পড়েননি বা শোনেননি পঙ্কজ। কবিতার নাম, 'চির আমি'।
কবিতাটির প্রথম লাইন পড়েই আবিষ্ট হলেন পঙ্কজ। আহা, কী তার ভাব, কী অপূর্ব উপলব্ধি, কী সনাতন আবেদন! কবিতাটি স্বতঃই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল শেষ চরণ অব্দি। পড়লেন, পুনরায় পড়লেন। গহন প্রানের উৎসার হয়ে গুনগুন করে উঠল মন। মনে হল, এ-কবিতায় তো সুর দেওয়া যায়! হৃদয় নিংড়ানো সুন্দর এক সুর! ভেতর হতে সুরমালা ছুটে এসে এখনই যেন কবিতার প্রতিটি চরণ জড়িয়ে ধরতে চাইছে! উদ্বেল হয়ে পঙ্কজ ছুটলেন সামনের গণেশ পার্কে।
পার্কে তখন দ্বিপ্রহরের নির্জনতা। সেই নির্জনে গুনগুন করতে করতে একসময় ধীরে ধীরে শেষ চরণটিকেও সুরে বেঁধে ফেললেন পঙ্কজ। নব সৃষ্টির আনন্দে স্নাত পঙ্কজের ইচ্ছে হল সম্পূর্ণ গানটি একবার যন্ত্রে বাজিয়ে গাইতে। দুর্গাদাসবাবু না-ফেরা অব্দি তো গুরুগৃহে যন্ত্র নিয়ে বসা যাবে না। তাহলে উপায়?
পার্কের প্রায় গায়েই 'আনন্দ পরিষদ'-নামের এক সৌখিন নাট্যদলের অফিস। নাট্যদলের হোতা, লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র। অফিসে যাতায়াত আছে পঙ্কজের। লক্ষ্মীদা তাঁকে খুব ভালোবাসেন। 'আনন্দ পরিষদ' তাঁর জন্য অবারিতদ্বার। সবচেয়ে বড় কথা ওখানে একটি সুন্দর অর্গান আছে।
ব্যস, অর্গানের কথা মনে হতেই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা হল পঙ্কজের। তিনি ছুটলেন সেখানে। গিয়ে দেখলেন দরজা খোলা, লক্ষ্মীদা কাছাকাছি নেই। না থাক, তিনি একেবারে গিয়ে বসে পড়লেন অর্গানে।
"আমার যুগ আমার গান"- স্মৃতিকথায় পঙ্কজবাবু এই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন :
"সুর মিলতে লাগল, আমি গলা দিতে থাকলাম। রবীন্দ্রনাথের বাণীতে সুর দিয়েছি নিজে, সেই সুর যন্ত্রে তুলে গলা মিলিয়ে গাইছি, ভাবতেও শিহরণ লাগছে, এমন সময় কে যেন পিছন থেকে বলে উঠল--উঁহু, উঁহু, একটু যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।
"চমকে উঠে ফিরে দেখলাম আমাদের লক্ষ্মীদা--লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র। গান থামিয়ে বললাম--কী বলছেন লক্ষ্মীদা, আপনার কথার মানে আমি বুঝতে পারছি না। এটা তো রবি ঠাকুরের কবিতা, আজই আমি নিজে নিজে সুর লাগিয়েছি...
"--সে কী, এটা তো রবিবাবুর একটা গান, ওঁর নিজেরই সুর দেওয়া আছে। আরে, তুমি তো তা-ই গাইছ, মাঝে মাঝে সামান্য তফাৎ হচ্ছে।..
"কী বলব, সেই মুহূর্তে আমার সমস্ত চৈতন্য প্রথমে বিস্ময়ে ও পরক্ষণেই এক অপার্থিব পুলকে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। ...আমি কেবল সুর দিতেই পারি না, কবির নিজের দেওয়া সুরের সঙ্গে আমার সুর কিনা প্রায় মিলে যায়!"
হ্যাঁ, মিলে যায়। মিলে গিয়েছিল সেদিন। এখানে বলে রাখি, এই মিলনমেলার 'চির আমি' কবিতাটিই আসলে আমাদের অতিপরিচিত গান : 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন'। ভাবলোকের মিল হলে সুর-লোকের এমন মিলন ঘটে বৈকি।
কবির সঙ্গে শিল্পী পঙ্কজের সেই ভাবলোকের মিল ছিল বলেই 'দিনের শেষে ঘুমের দেশে' গানে (কবিতায়) পঙ্কজের দেওয়া সুর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অত্যন্ত পছন্দ করেছিলেন এবং অনুমোদন দিয়ে আপন সুরের রাজ্যে পাংক্তেয় করেছিলেন; যা রবীন্দ্র সঙ্গীতের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, অভাবনীয় গৌরবের ঘটনা।
কবির সঙ্গে শিল্পী পঙ্কজের সেই ভাবলোকের মিল ছিল বলেই, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পঙ্কজ সিনেমায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহারের অনুমতি আদায় করে তাকে আপামরের করে তোলার পথটি বিনির্মাণ করতে পেরেছিলেন। স্রষ্টা ও শিল্পীর ভাবলোকের মিল ছিল বলেই শান্তিনিকেতনী উন্নাসিকতার মাঝে তথাকথিত আধুনিক সঙ্গীতশিল্পীও যে খ্যাতিমান রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী কিংবা রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পীও খ্যাতিমান আধুনিক সঙ্গীতশিল্পী হতে পারেন-পঙ্কজ এই দৃষ্টান্ত সার্থকভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। আসলে, রবীন্দ্র সঙ্গীতকে সাধারণের ঘরের সামগ্রী করে তোলার কৃতিত্ব অনেকটাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের, এটা যেমন সত্যি; তেমনি এও সত্যি যে, তাঁর পূর্বসূরী কিন্তু পঙ্কজকুমার মল্লিক।