বাঙালির গর্ব ডাক্তার নীলরতন সরকার

অরুণকুমার চক্রবর্তী তাঁর 'চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালী' বইটিতে ডাক্তার নীলারতন সরকার সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে জানাচ্ছেন যে, "এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে তাঁর মাতার মৃত্যু হওয়ায় তিনি চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হন।" 

আবার অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী তাঁর 'স্মৃতিভারে' স্মৃতিগ্রন্থে জানাচ্ছেন, "শোনা যায়, তাঁর পিতৃদেবের অন্তিম ব্যাধিতে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয় নি, এই দুঃখ নিয়ে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যয়নে ব্রতী হন এবং তাতে ভাবনানুযায়ী সিদ্ধিলাভ করেন।"

দুটি বয়ানে বিরুদ্ধতা থাকলেও, একটি জায়গায় মিল আছে, সেটি হচ্ছে নিকটজনের অসহায় মৃত্যু। আর সেই মৃত্যুই বদলে দিয়েছিল ডায়মন্ডহারবারের নেত্রা গ্রামের প্রায় দরিদ্র পরিবারের ছেলে নীলরতনের হয়ে ওঠার অভিমুখ।

স্বপ্ন ও জেদের মুখে দারিদ্র্য বাধা হয়ে উঠতে পারল না। নীলরতন নিজের যোগ্যতায় বৃত্তি নিয়ে ক্রমে এম ডি পরীক্ষায় পাশ করলেন। সেকালে এটিই ছিল চিকিৎসাবিদ্যায় সর্বোচ্চ দেশীয় ডিগ্রি। এই ডিগ্রি নিয়ে তিনি অনায়াসেই সরকারের অধীনস্থ হাসপাতালে বড় চাকরি পেতে পারতেন; কিন্তু পেতে চাইলেন না।

আসলে নীলরতন দেখেছিলেন যে, সরকারি ডাক্তারদের অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে। তাঁরা মোটেই স্বাধীন নন। সাহেব ডাক্তাররা এ-দেশি মানুষদের প্রতি যতটা উন্নাসিক, তার চেয়েও বেশি উন্নাসিক সরকারের সাহেব সাজা এ-দেশি ডাক্তারেরা। তাই এই বৃত্তটার মধ্যে নীলরতন ঢুকতেই চাইলেন না।

তাছাড়া তিনি দেখেছেন, অভিজাত ও উচ্চমধ্যবিত্তশ্রেণি সাহেব ডাক্তারদের যতটা সম্মানের চোখে দেখে, দেশীয় ডাক্তারদের ততটাই হীন ভাবে। তাদের কাছে যত ডিগ্রির জাঁক, তত বেশি ফি, তত বড় ডাক্তার। সাহেব ডাক্তারেরা জাতটার নাড়ি টিপে এই মানসিক ব্যাধিটি টের পেয়েছিল বলেই তাদের ফি'র হররা ছিল দেখার মতো।

এই পরিস্থিতিতে নীলরতন চাইলেন স্বদেশীয় স্বাধীন ডাক্তারদের সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করতে। তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি স্বাধীনভাবে চেম্বার খুলে ডাক্তারি শুরু করলেন। আর, ফি নির্দিষ্ট করলেন সাহেব ডাক্তারের সমান। ষোল টাকা।

শুধু ফি বাড়িয়ে নয়; রোগীর কথা মন দিয়ে সময় দিয়ে শুনে সুচিকিৎসার মধ্য দিয়ে অগাধ আস্থা ও সম্ভ্রম অর্জন করে নীলরতন সকলের কাছে অল্পদিনেই হয়ে উঠলেন সাক্ষাৎ 'ধন্বন্তরি'।


কিন্তু, ষোল টাকা আজ থেকে একশ বছর আগে, অনেক টাকা। বড়লোকেরা না-হয় দিল, গরীবেরা?


এ-প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি, অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তীর স্মৃতি থেকে। যে-সময়ের গল্প, তখন অবশ্য নীলরতনের ফি ষোল থেকে বেড়ে হয়েছে বত্রিশ:

রঘুনন্দন গোস্বামী নামের এক ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ, কিন্তু তাঁর ছেলেটির অবস্থা আরও খারাপ। সেকেলে দুরারোগ্য যক্ষ্মা রোগে ভুগছে, সার্কুলার রোডের একটি সস্তার মেসে থাকে। আই এ পরীক্ষা সামনে, তার মধ্যেই বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে। গায়ে জ্বর, কাশিও হচ্ছে খুব। 

জনার্দনের বিশেষ পরিচিত এঁরা। জনার্দন এমএ ক্লাসের ছাত্র। বন্ধুদের ধরে বিনিপয়সায় দু'জন ভালো-সহৃদয় ডাক্তারকে পেয়েছেন। দু'জনেই চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। কিন্তু, তাঁদের চিকিৎসায় বিশেষ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

বাড়াবাড়ির খবর পেয়ে ছেলেটির মা এলেন গ্রামের বাড়ি থেকে। তাঁর আশা ডাক্তার সরকার একবার এসে দেখলে তাঁর ছেলে ঠিক রক্ষা পাবে। 

মায়ের সকরুণ অনুনয়ে ততটা সামর্থ্য না-থাকলেও জনার্দন গেলেন ডাক্তার সরকারকে 'কল' দিতে। ডাক্তার সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, 'আমার ফি কত জানা আছে ত?' 

জনার্দন জানালেন, জানা আছে, পারবেন দিতে। 

বেশ। ডাক্তার সরকার কথা দিলেন পরদিন সকালে আসবেন।

পরদিন মেসে ঢুকেই ডাক্তার সরকার ছেলেটির পারিবারিক অবস্থা টের পেলেন। টের পেলেন ছেলেটির শারীরিক অবস্থাও। মন দিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন। যে-দুজন ডাক্তার তাকে নিয়মিত দেখছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর ওষুধ ও ব্যবস্থা বুঝিয়ে যখন বিদায় নিচ্ছেন, তখন জনার্দন ফি'র টাকাটা দিতে গেলেন। 

কিন্তু, ডাক্তার সরকার শান্ত গলায় বললেন, "ফি আমি নিয়ে থাকি, কিন্তু সব জায়গায় কি নিতে হয়? যাও, রোগীর শুশ্রূষা ও পথ্যের ভালো ব্যবস্থা কর। তাঁর মা-বাবাকে সান্ত্বনা দাও, তাঁরা বড় উতলা হয়েছেন।"

'কল' দিতে তিনি আরও একবার এসেছিলেন, রোগীকে দেখে গিয়েছিলেন এবং যথারীতি ফি নেননি।শেষ পর্যন্ত ছেলেটি বাঁচেনি। কিন্তু, এই ডাকাডাকিতে জনার্দন ডাক্তার সরকারের সহৃদয়তার পরিচয়টুকু অন্তত পেয়েছিলেন।

আসলে, অভাবে প্রিয়জনের চিকিৎসা না-করাতে পেরে হারানোর যন্ত্রণা নীলরতন কোনদিনই ভুলতে পারেননি। তাই, বড়লোকের জন্য তাঁর কাছে যেমন বড় ফি-র ব্যবস্থা ছিল; তেমনি গরীবদের জন্যও তাঁর সহৃদয়তা ও সহানুভূতির কোন খামতি ছিল না।

বত্রিশ থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে তাঁর ফি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল শেষমেশ চৌষট্টি টাকায়। এই যে এত ফি, এত উপার্জন; টাকাগুলো কোন কাজে লাগত, বিলাস-ব্যসনে?

একেবারেই না। 

ডাক্তার সরকার দরিদ্রদের বিনিপয়সায় চিকিৎসা তো করতেনই, প্রয়োজনে ওষুধ-পথ্য জোগানোর দায়ও নিজের কাঁধে নিতেন। 

তাছাড়া, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মতো তিনিও বাঙালিকে স্বনির্ভর ও স্বাবলম্বী করে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর কঠিন স্বপ্ন দেখেছিলেন। এবং, সেই সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন। বাঙালি ছেলেমেয়েদের কর্মসংস্থানের কথা ভেবে স্বকৃত উপার্জনের অর্থ দিয়ে ট্যানারির ব্যবসা শুরু করেছিলেন, সাবানের ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বেশ কিছু চা-বাগান কিনে চালাতেও শুরু করেছিলেন।

এছাড়া, চিকিৎসাবিদ্যা-শিক্ষায় স্বদেশ যাতে স্বনির্ভর হতে পারে, সেজন্য চিকিৎসক বন্ধুদের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছিলেন দেশের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, 'ক্যালকাটা মেডিকেল স্কুল ও কলেজ অব ফিজিক্স এন্ড সার্জনস অব বেঙ্গল'।

চিকিৎসকদের সংঘবদ্ধ করে তুলতে নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলেন, 'ক্যালকাটা মেডিকেল ক্লাব'। তাছাড়াও কত শত চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের স্বদেশী প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে যে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন, তার ইয়ত্তা নেই।

স্বদেশকে স্বনির্ভর করার কাজে নেমে, ব্যবসার লোকসান সামাল দিতে দিতে ডাক্তার সরকারের উপার্জন একসময় শুধু যে তলানিতে এসে ঠেকেছিল তাই নয়; শেষ পর্যন্ত দেনার দায়ে তাঁর বসতবাড়িটি পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তবু খেদ ছিল না তাঁর। বলতেন, "কলকাতায় কুড়ি টাকায় ঘর ভাড়া পাওয়া যায়, তাতেই আমার চলে যাবে।" কতটা সহৃদয় হলে এ-কথাটা বলা যায়, সেটা অনুভবের বিষয়।

তাই, শুধু ডাক্তার হয়ে নয়, সুচিকিৎসা দিয়ে নয়, খ্যাতির শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে নয়; যে মানবিকতা-সহৃদয়তা ও উদারতা থাকলে একজন মানুষ চিরস্মরণীয় হয়ে ওঠেন, তারই পরাকাষ্ঠায় আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন ডাক্তার নীলরতন সরকার।


তথ্যঋণ : 'স্মৃতিভারে'- জনার্দন চক্রবর্তী; 'চিকিৎসা বিজ্ঞানে বাঙালী' - অরুণকুমার চক্রবর্তী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...