তুলসি চক্কোত্তি-মলিনার দেবীর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’র নাম কেন হল ‘সাড়ে ৭৪’

"পিছনে দিব্বি দেওয়া থাকত সাড়ে চুয়াত্তর"

প্রেমের চিঠির খামের ওপর লেখা থাকত ৭৪।।০। গোপন চিঠির চিহ্ন। সে চিঠি যেন আর কেউ না পড়ে। খুললেই গায়ে লাগবে অভিশাপ। তেমন চিঠি আর আসে কই!

রান্নাঘর-তুলসিতলা-কাচ্চাবাচ্চার বায়না আর জ্বর সর্দির সংসার। দু’দন্ড স্ত্রীকে কাছে পাবার জো নেই সোয়ামির। কী করেন রজনীবাবু! তিনি আক্ষেপ করেন, আর সংসার সামলাতে নাস্তানাবুদ তাঁর স্ত্রীর মেজাজটি হয়ে যায় দিনদিন খিটখিটে। তাঁর অমন মনমোহিনী ষোড়শী রূপটি কবে যে রণচণ্ডীতে বদলে গেল সে খবর রজনীবাবু রাখেননি। কাব্যি করা প্রেমের চিঠিও উধাও হয়ে গেছে জীবন থেকে!

a5fef818-91a4-4a08-a12d-f6ff5fbbc69d

মাথার চুল পড়েছে। বাত এসেছে হাঁটুতে। তিনিও ব্যাগপত্তর নিয়ে কলকাতাবাসী। সেখানকার এক মেসবাড়ি রজনীবাবুর প্রাণের টানের আখড়া। অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউজ।

একবাড়ি যুবকের হইচই আর কান্ডকারখানায় যেন খুঁজে পান হারিয়ে যাওয়া যৌবনের দিনগুলো। সে মেসবাড়ি মন কেড়েছিল বাংলার সিনেমাপ্রেমীদের। আজও স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ওটিটি প্লাটফর্মে মুড ভাল করে দেওয়ার দাওয়াই হিসেবে ‘সার্চ’ হয় এই ছবি।

কিন্তু কোনও কেন এই ছবির নাম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’? সে খোঁজ মাথায় এলে মনে হয় হয়ত কোনও সালের নাম বা মেস বাড়ির ঠিকানা। পর মুহূর্তেই মন থেকে ডিলিট হয়ে যায় সেই ভাবনা।

সাড়ে চুয়াত্তর আসলে অভিশাপ। গোপন চিঠিতে এই সংখ্যা লিখে দিলে একমাত্র প্রাপক ছাড়া আর কেউ সেই চিঠি খোলার সাহস দেখাত না। এমন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ চিঠির অপেক্ষায় থাকত প্রেমিকরা।

5e11e3c8-9908-41f2-871a-0590eccce498

অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউজে তো বাড়ি ভর্তি প্রেমিক!

এই বাড়ির গল্প নিয়েই ছবি করেছিলেন নির্মল দে। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের সুপারহিট পরিচালক তিনি। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত তাঁর ‘ফ্যান’। ছবির গল্পকার বিজন ভট্টাচার্য

এক ঝাঁক তারকা ছিল ছবিতে। উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, তুলসি চক্রবর্তী, মলিনা দেবী, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও পদ্মা দেবী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, নবদ্বীপ হালদার, শ্যাম লাহা। শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখার্জী ও সনৎ সিংহ তিন গানের মানুষও ছিলেন ছবির গানের দৃশ্যে। মারকাটারি সংলাপের দুরন্ত কমেডি ছবি।   

ছবির কেন্দ্রে রামপ্রীতি আর রমলা। অভিনয়ে উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন। তবে তাঁদের বলে বলে গোল দিয়েছিলেন রজনীবাবু আর তাঁর স্ত্রী। তুলসি চক্রবর্তী আর মলিনা দেবী। ছবির আসল ‘হিরো-হিরোইন’ তাঁরাই।

অন্নপূর্ণা বোর্ডিং হাউজের রামপ্রীতি আর রমলা প্রেমে পড়ে মেসের কাজের লোক মদনকে দিয়ে চিঠি পাঠাত একে অপরকে। সেই চিঠি নিয়েই বাঁধে যত গোল। তার টানেই এগোয় ছবির কাহিনি।

১৯৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম ছবি ‘সাড়ে ৭৪’। আট সপ্তাহ ধরে উত্তরা, পূরবী, উজ্জ্বলা এবং প্যারাডাইসে চলে ছবি। যথারীতি সুপারহিট!  

অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই ছবি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘সাড়ে ৭৪ বাংলার সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ কমেডি ছবি। আর ও রকম নায়ক-নায়িকা জুটির তো তুলনাই হয় না। নায়ক-নায়িকা বলতে বোঝাচ্ছি, তুলসীবাবু আর মলিনাদেবীকে। পার্শ্ব ভূমিকায় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই সংলাপ ‘মাসিমা মালপো খামু’ তো প্রবাদ হয়ে গেছে’।

‘মাসিমা মালপো খামু’-র শুটিংয়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরিচালকের বাড়ি থেকে আসা ২৫টা মালপোয়া খেতে হয়েছিল।

ছবি নিয়ে মাতামাতি হলেও ছবির নাম নিয়ে কিন্তু দর্শকদের বড় অংশের তেমন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এই ছবির সব রহস্য ওই চিঠির খামেই।

কেন ‘সাড়ে ৭৪’ অভিশাপ?

চিঠির খামে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ লেখা আসলে এক প্রথা। রাজস্থান এবং উত্তর ভারতে এই প্রথা প্রচলিত ছিল একসময়। শুরুতে শুধুমাত্র গোপন চিঠির জন্যই এই প্রথা চালু ছিল। পরে প্রেমপত্রের খামে লেখা থাকত সাড়ে চুয়াত্তর। রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশ থেকে ক্রমশ এই প্রথাটি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। সেভাবেই অবিভক্ত বাংলাতেও চল শুরু হয়।

‘সাড়ে চুয়াত্তর’ প্রথার নেপথ্যে আছে একাধিক কাহিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা সবই করুণ রসের।  

১৩০৩ সালে দিল্লীর সিংহাসনে তখন আলাউদ্দিন খিলজী। খিলজী চিতোর আক্রমণ করলেন। লোক কাহিনি বলে, চিতরের রাণী পদ্মিনীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে খিলজী এই কাজ করে। পদ্মিনীর স্বামী চিতোরের রাজা রতন সিং তার সভাসদ বংশীবাদক রাঘব চেতনকে চুনকালি মাখিয়ে গাধার পিঠে তুলে রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছিলেন। রাঘব চেতনের নাকি গোপন তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে চিতোর রাজ্যের ক্ষতি করছেন, এই ছিল অভিযোগ। রাঘব সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চিতোররাজের বিরুদ্ধে হাত মেলায় খিলজীর সঙ্গে। রাঘবের কাছে পদ্মিনীর রূপের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় খিলজী। সিদ্ধান্ত নেন মেওয়ার রাজ্য অভিযানের। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মেওয়ারের রাজধানী চিতোর অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু চিতোর জয় যতটা সহজ মনে করেছিলেন খিলজী, বাস্তবে দেখলেন তাঁর অনুমান মিলল না।

ছপাহাড়ের ওপর অবস্থিত চিতোরগড়ের কেল্লা এক দূর্ভেদ্য দূর্গ, বাইরে থেকে তার ক্ষতিসাধন অমম্ভব।

তখন  সুলতান রাজা রতন সিং এর কাছে দূত পাঠালেন। বলা হলে, সুলতানের দূর্গ দখল কিংবা রাজ্যদখলের কোন মতলব নেই; তিনি কেবল রানী পদ্মিনীকে দেখতে চান।

রতং সিং পড়ে গেলেন মহা সমস্যায়। একদিকে অন্দর মহলের সম্মান অন্য দিকে সুলতানের বিশাল আগ্রাসন। চিতোরগড় দূর্ভেদ্য হলেও এক সময় সরাসরি লড়াই বাঁধবেই।  সুলতানের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা দুঃসাধ্য।

তাই রাজাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হতে হল পদ্মিনী দর্শনে।  এভাবেই যদি প্রজাদের রক্ষা করা যায় াসন্ন বিপদ থেকে। রাণী পদ্মিনী শর্ত দিলেন যে তিনি সরাসরি সুলতানকে দেখা দেবেন না, সুলতান আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখবেন।

সুলতান আলাউদ্দিন এই শর্ত মেনে তাঁর সঙ্গী অনুচরদের নিয়ে অতিথির বেশে কেল্লায় প্রবেশ করলেন। কথামত রাণী পদ্মিনীও তার মহলে আয়নায় দেখা দিলেন। সুলতান রাণীর রূপের বর্ণনা যা শুনে এসেছেন, বাস্তবের রাণী পদ্মিনী তার চাইতেও অনেক রূপবতী।

কেল্লা থেকে অতিথিদের বিদায় দিতে রাজা রতন সিং সৌজন্য বশতঃ সুলতানকে কিছু পথ এগিয়ে দিতে এলেন। সুলতান এটাকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে আচমকা রতন সিংকে বন্দী করে তার শিবিরে নিয়ে গেলেন। এরপর চিতোরগড় কেল্লায় খবর পাঠালেন, কাল সকালের মধ্যে রাণী পদ্মিনীকে তার শিবিরে পাঠিয়ে দিলে তিনি রাজা রতন সিংকে মুক্তি দেবেন।

শুরু হল যুদ্ধ। বিশাল সুলতানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে হার মানতে হল চিতোরের বাহিনীকে। রাজ্যের পতনে প্রাসাদের নারীদের আত্মসম্মান রক্ষার্থে রাণী পদ্মিনী জহরব্রত করে মৃত্যুবরণ করলেন। মরণযাত্রায় সঙ্গী সৈন্য এবং অনুগামীরাও। সৈন্য ও রাণীদের ছাইভষ্মের ওজন নাকি ছিল সাড়ে চুয়াত্তর মন!

‘সাড়ে ৭৪’ প্রথার অন্য গল্পটি সম্রাট আকবরের।

১৫৬৭ সালে মেবারের মহারাণা দ্বিতীয় উদয় সিংকে হারিয়ে আকবর চিতোর দখল করার পর প্রমাণ হিসাবে তাঁর সৈন্যরা অসংখ্য রাজপুত সৈন্যের মৃতদেহ থেকে যজ্ঞোপবীত (যাকে আরবীতে জুনর বলে) খুলে নিয়ে এসে দেখায়। সেই সম্মানগ্রন্থির সম্মিলিত ওজন হয় সাড়ে চুয়াত্তর মণ।

তৃতীয় গল্পটিও এই যুদ্ধের সাথে জড়িত। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দুর্গের ভিতরের নারীরা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করে। সেই সূত্রেই রাজস্থান এবং উত্তর ভারতে গোপনীয় চিঠির সামনে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সংখ্যাটি লিখে রাখার প্রথা চালু হয়। মানে প্রাপক ছাড়া অন্য যে ব্যক্তি এই গোপনীয় চিঠিটি খুলে পড়বে তার ভাগ্যে সাড়ে ৭৪ মন ওজনের যজ্ঞোপবীতধারী নরহত্যার সমান পাপ হবে। অথবা ৭৪ মন ওজনের গয়নার অধিকারী নারীহত্যার সমান পাপ হবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...