'জাগো হে এই নগরবাসী... মুখে জয় রাধা শ্রী রাধা বইলা পোহাইলো নিশি...' -এই কথা, এই গায়কী, এই সুর যেকোনও সময়ই আপনাকে এনে দিতে পারে ভোরের প্রচ্ছন্নতা, প্রসন্ন ভাবে মনকে জাগিয়ে দেওয়া প্রভাতী গানের সেই প্রচ্ছন্নতাকে সহজলভ্য করে তুলেছিলেন সদ্য প্রয়াত শিল্পী অমর পাল। ২০ এপ্রিল ৯৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন দুই বাংলার লোকগানের এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পী।
অবিভক্ত ওপার বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ১৯২২ সালের ১৯ মে জন্ম নেন অমর পাল। ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে সংসারের ভার তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন গানপাগল। মা দুর্গাসুন্দরী দেবীর কাছেই পেয়েছিলেন লোকসংগীতের তালিম। পাশাপাশি উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নেন ওস্তাদ আয়াত আলী খানের কাছে।
১৯৪৮সালে আকাশবাণীর গীতিকার শচীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কলকাতায় যান অমর পাল। সেখানে বেঙ্গল মিউজিক কলেজের অধ্যাপক মণি চক্রবর্তী, সুরেন চক্রবর্তী, ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নতুন করে শেখেন লোকসংগীত। পল্লীগীতিই হয়ে উঠেছিল তাঁর মনের কোমল নিষাদ। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের লোকসংগীতের শিল্পী হিসেবে অমর পাল প্রথম লোকসংগীত পরিবেশন করেন ১৯৫১ সালে। তিনিই প্রথম লোকশিল্পী যিনি গান গেয়েছেন আকাশবাণীতে।
অমর পাল ভারত সরকারের সংগীত-নাটক আকাদেমি পুরস্কারসহ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালন পুরস্কার ও সংগীত মহাসম্মান পেয়েছেন। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি।
তাঁর গাওয়া ‘প্রভাত সময়ে’, ‘জাগো হে এ নগরবাসী’, ‘রাই জাগো’, ‘প্রভাতে গোবিন্দ নাম’, ‘রাই জাগো গো’, ‘ভারতী গৌরাঙ্গ লইয়া’, ‘হরি দিন তো গেল’, ‘মন রাধে রাধে’, ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী’, ‘জাগিয়া লহো কৃষ্ণ নাম’, ‘আমার গৌর কেনে’, ‘আমি কোথায় গেলে’ ইত্যাদি গানগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের গানেও নিজের দক্ষতা স্পষ্ট করেছিলেন। দেবকী কুমার বসু, সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে গান গেয়ে দারুণ প্রশংসিত হন তিনি। শুধু তাই নয়, বহু বাংলা ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘হীরক রাজার দেশ’ ছবিতে তাঁর গাওয়া ‘আমি কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ এখনো মন ছুঁয়ে যায় শ্রোতাদের। সময় বলছে এখন আর কেউ পল্লীগীতি শোনেনা। বোধহয় পল্লীগীতির সঙ্গে সঙ্গে 'অমর পাল' নামটাই প্রজন্মের কাছে মুছে গিয়েছিল অনেক আগে, তাই এ কথা বলা যেতেই পারে যিনি বাংলার পল্লীগীতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরে, তাঁর প্রয়ানে এবার প্রকৃত অর্থেই অবসান হল বাংলার 'পুরনো' লোকগানের একটি অধ্যায়ের।