সপ্তাহের শুরু। ফলে, সবাইকেই কাজের উদ্দেশ্যে বেরোতেই হবে। কিন্তু রবিবার রাত থেকেই তো রেমালের তান্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে। ল্যান্ডফলের পর কয়েক ঘণ্টা টানা বর্ষণ হয়েছে কলকাতায়। ফলে সোমবার সকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে একটা ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। একদিকে যেমন বিঘ্ন মেট্রো পরিষেবা। অন্যদিকে, রাস্তায় চলছে হাতেগোনা কয়েকটা বাস। বাড়ি থেকে কোনওভাবে বেরোলেই দেখা মিলছে জলমগ্ন রাস্তা। অনেকেই ভাবছে বাড়ি থেকে কাজ করবে। সেখানেও সমস্যা। রেলারে দাপটে উড়ে গিয়ে কারেন্ট। এমনই একটা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছিল কলকাতা শহরে। অফিসযাত্রী থেকে কলেজ পড়ুয়া— সবাই ছিল এক বিপাকের মুখে!
এক সপ্তাহ যদি শহরে বৃষ্টি হলে শহরবাসীকে এমনই এক দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে হবে। কিন্তু রেমাল সেটা দেখিয়ে দিল একদিনে!
একের পর এক লাইনে গাছ পড়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলাচল। ফলে, অন্য জেলা থেকে আসাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এদিকে, শহরে বন্ধ হয়ে যায় অটো পরিষেবা। রাস্তার আনাচে কানাচে জমে গিয়েছে জল। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুজল। খিদিরপুর সংলগ্ন কলকাতা বন্দর এলাকার হাইড রোডে জলে থৈ থৈ। আবার বেহালা থেকে পাঠকপাড়া, ঠনঠনিয়া থেকে বাঁশদ্রোণী। উত্তরে এগোলে জলে বাগবাজারের কিছু অংশ, বিধান সরণির কিছুটা, সিটি কলেজের আশপাশ। সমস্ত জায়গাই জলমগ্ন। এই কারণে অনেকের বাড়িতেই ঢুকে গিয়েছে জল। সোমবার সকালে প্রবল হয়ে উঠেছিল গঙ্গা। এক সময় জল ঢোকা রোধ করতে মিলেনিয়াম পার্কে লকগেট বন্ধ করা হয়।
এদিন অনেকেই ভাবছিলেন পাতাল রেলের নির্ভর করে অফিস এবং স্কুলের সময়ে পৌঁছে যাবে। তবে, সোমবার কলকাতা মেট্রোর পরিষেবাও রেমালের কাছে হার মেনেছে।
রবিবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিট পর্যন্ত নিউ গড়িয়া সংলগ্ন কবি সুভাষ থেকে টালিগঞ্জ সংলগ্ন মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশন পর্যন্ত সাময়িক বন্ধ রাখা হয় মেট্রো পরিষেবা। কারণ, মেট্রো সুত্রে জানা গিয়েছিল যে দুপুরের দিকে গড়িয়া সংলগ্ন কবি নজরুল স্টেশনে ভাঙা শেডের একাংশ ফের ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে খুলে যায়। ওই সময়ের মধ্যে মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশন থেকে দক্ষিণেশ্বরের মধ্যে মেট্রো অবশ্য চলছিল।
তবে সোমবার বিপদ বেড়ে যায় মেট্রো পরিষেবায়!
দেখা গিয়েছে সোমবার সকালে পার্ক স্ট্রিট এবং এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনের মাঝের ট্র্যাকে জল ঢুকে যায়। ফলে, স্টেশনের একাংশ এবং পুরো ট্র্যাকই চলে যায় জলের তলায়। আর তার জেরেই সকাল সকাল ব্যাহত হয় মেট্রো পরিষেবা। সকাল ৭টা ৫১ মিনিট থেকে মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হয়। পার্ক স্ট্রিট-এসপ্ল্যানেডে জল জমার কারণেই গিরিশ পার্ক থেকে শুরু করে টালিগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
মেট্রোর তরফে জানানো হয় যে যাত্রী সুরক্ষার কথা ভেবে তাঁরা প্রথমে কবি সুভাষ থেকে টালিগঞ্জ এবং গিরিশ পার্ক থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত ভেঙে মেট্রো চালু করে। অন্যদিকে, কর্মীরা পাম্পের সাহায্যে লাইন থেকে জল সরাচ্ছিলেন। কিন্তু বাইরে প্রবল বৃষ্টির কারণে পার্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড, ময়দান এলাকায় জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ফলে, লাইন থেকে জল ফেলতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় মেট্রোর কর্মীদের।
এরপর সকাল ১০টা ২১ মিনিটে ময়দান থেকে কবি সুভাষ পর্যন্ত মেট্রো চলাচল শুরু হয়। তারপর দুপুর ১২টা ০৫ মিনিট থেকেই যাত্রীদের জন্য পুরোপুরি স্বাভাবিক করা হয় মেট্রো পরিষেবা।
শুধু সাধারণ মানুষেরা নয়, এদিন রেমালের সঙ্গে সারা দিন লড়াই করে টলিপাড়া। দেখা গিয়েছিল যে কোথাও বন্ধ ছিল শ্যুটিং। আবার কোথাও ঝড়-বৃষ্টির সাথেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে দিনভোর চলছিল কাজ। সোমবার টলিপাড়ায় একাধিক ধারাবাহিকের শুটিং যেমন বন্ধ ছিল, ঠিক তেমনই কিছু ধারাবাহিকের এপিসোড শ্যুটিং হয়। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ কিছুটা দেরিতে কাজ শুরু হয়েছে সমস্ত ফ্লোরে।
সোমবার শহরে কতজনের প্রাণ কাড়ল রেমাল?
কলকাতায় রেমাল ঝড়ের দাপটে চলে গেল একটা প্রায়! ঘটনাটি ঘটে কলকাতা পুরসভার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড, এন্টালির ১০ নম্বর বিবির বাগান এলাকায়। ঝড়ের মাঝে ছেলেকে খুঁজতে গিয়েছিলেন এক প্রৌঢ়। ঠিক সেই সময়েই কার্নিস ভেঙে পড়ে তাঁর মাথায়। রবিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় সুত্রে জানা গিয়েছে আহত প্রৌড়কে তৎক্ষণাৎ এনআরএস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে সেখানে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। নিহতের নাম শেখ সাজিদ।
ঝড়ের সময় বহু গাছ ভেঙে পড়ে। এই গাছ ভেঙে পড়ার কারণেও অনেকের মৃত্যু হয়ে যায়। ফলে, এই কারণে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল মহানগর।
রেমাল রবিবার রাত ৮টা নাগাদ দিকে মোংলা বন্দরের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল এবং বাংলাদেশের খেপুপাড়া উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করেছিল। ওই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলের বিভিন্ন জেলায় প্রবল ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। রাত দেড়টা থেকে ২টো মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১১ কিলোমিটার গতিতে ঝড় বয়ে গিয়েছে পটুয়াখালির খেপুপাড়ায়। জানা যায় ঝড়ের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় ছ’টি জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৩৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। বাংলায় মৃতের সংখ্যা ছিল সাত।
কলকাতা পুরসভা সুত্রে জানা গিয়েছে যে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে শহরে ভেঙে পড়েছে ২৯৪টি গাছ।
রবিবার রাতে ঝড়ের তাণ্ডবে গাছ পড়ে বন্ধ হয়ে যায় শেক্সপিয়র সরণি, পার্ক স্ট্রিট, আলিপুর রোড, গণেশ অ্যাভিনিউ, স্ট্র্যান্ড রোড, সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউয়ের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোয়। এরপর সোমবার সকালের দিকে ক্যাথিড্রাল রোড, পার্ক স্ট্রিট ও ক্যামাক স্ট্রিটেও উপড়ে পড়ে গাছ।
পুরসভা সূত্রে আরও জানা গিয়েছে যে শহরে সব থেকে বেশি গাছ ভেঙে পড়েছে ১০ নম্বর বরো এলাকায়— ৪১টি গাছ। এচছাড়া, সাত নম্বর বরো এলাকায় ৩৮টি গাছ, নয় ও তিন নম্বর বরো এলাকায় যথাক্রমে ২৫টি ও ২৪টি গাছ। ১৩ ও ১৪ নম্বর বরো এলাকায় ১৮টি করে গাছ ভেঙে পড়েছে। ১৬ নম্বর বরো এলাকায় ভেঙেছে ২২টি গাছ ভেঙে পড়ে। দেখা গিয়েছে এই ভেঙে পড়া গাছের মধ্যে ছিল কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল প্রভৃতি।
তবে, দুর্যোগের সময় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হবে, এমন আশঙ্কা আগেই করেছিল লালবাজার। ফলে, সমস্ত এলাকার থানা ও ট্র্যাফিক গার্ডের পুলিশকে আগেই থাকতে সতর্ক করে হয়েছিল। ফলে, তাঁরা তৈরি ছিল গাছ কাটার যন্ত্র ও বিশেষ দল নিয়ে। গাছ পড়ার খবর পেতেই কলকাতা পুরসভা ও কলকাতা পুলিশের কর্মীরা বিপর্যয়ের মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে রাতেই গাছ কাটার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন।