অবনীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ : খামখেয়ালের যুগলবন্দি

ঠাকুরবাড়ির কাকা-ভাইপো--রবি ঠাকুর আর অবন ঠাকুর। দশ বছরের ছোট-বড়। যে সময়ের কথা বলছি, তখন বয়সের কোঠায় অবন সবে সাতের ঘরে পা দেবেন, আর রবি শেষ করবেন সাতের ঘর। অবন তখন কলকাতায় আর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে। সে-বার তাঁর খেয়াল হল, অবনের জন্মদিন করতে হবে--"অবন কিছু চায় না, জীবনে চায়নি কিছু। কিন্তু একটা লোক যে শিল্পজগতে যুগপ্রবর্তন করেছে, দেশের রুচি বদলে দিয়েছে। সমস্ত দেশ যখন নিরুদ্ধ ছিল, এই অবন তার হাওয়া বদলে দিলে। তাই বলছি, আজকের দিনে এঁকে যদি বাদ দাও তবে সবই বৃথা।" সুতরাং, ঠিক হল বেশ ঘটা করে অবনের জন্মদিন করতে হবে। ব্যস, অবন-শিষ্য নন্দলাল আর স্নেহধন্যা রাণী চন্দকে আয়োজনের ভার দিলেন রবীন্দ্রনাথ। জন্মদিন আসতে তখনও মাস খানেক বাকি। কিন্তু, বুড়ো বয়সে জন্মদিনের ঘটা!--এ কিছুতেই অবনের মনে সায় দিল না। তিনি তখন নিজস্ব খামখেয়াল কুটুম কাটাম পুতুল গড়ায় মজেছেন, তাই নিয়েই মগ্ন থাকেন সারাদিন। জন্মদিনের প্রস্তাবে তাঁর 'নেতি' কিছুতেই 'ইতি' হয় না। অবশ্য তাঁকে সাধে সাধ্য কার! শিষ্য নন্দলাল ঘুর ঘুর করেন, স্নেহধন্য রাণী বুঝিয়ে বলতে যান--কিন্তু, কে শোনে কার কথা! বেশি বলতে গেলে এমন ধমক লাগান যে, তাঁরা আর পালাবার পথ পান না। ওদিকে রবীন্দ্রনাথও তাড়ায় কমতি দিলেন না। সমানে রাণী সকাশে তাঁর খোঁজ চলতে লাগল, "অবনের জন্মোৎসব কতদূর কী এগোল?" জন্মদিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, রাণী ততই বুঝলেন অবনকে বাগে আনা অন্তত তাঁদের কম্মো নয়। সে-কথা কবুলও করলেন। রবীন্দ্রনাথের মাথায় কিছু একটা চাপলে--আর সবাই হাল ছাড়লেও তিনি যে সে-পাত্র নন--এ তো আর কারও জানতে বাকি নেই! ফলে, যা হওয়ার হল। তিনি সশরীরে সটান হানা দিলেন ভাইপোর দরবারে--"অবন, তোমার এতে আপত্তির মানে কী। দেশের লোক চায় কিছু করতে তোমার তো তাতে হাত নেই।" আর সবার কাছে হম্বিতম্বি করলেও কাকার কাছে সেটি করার জো নেই। কাকার কথার ওপর কথা কোনদিন বলেননি অবন। বুড়ো বয়সেও পারলেন না। বরং, বাধ্যবালকের মতো লজ্জিত হয়ে বললেন, "তা আদেশ যখন করেছ মালাচন্দন পরব, ফোঁটানাটা কাটব, তবে কোথাও যেতে পারব না কিন্তু।" বলেই তড়িঘড়ি প্রণাম করে খেয়ালি কাকার পাল্লা থেকে যেন পড়িমরি করে কেটে পড়ে বাঁচলেন। ভাইপোর সেই কাণ্ড দেখে রবীন্দ্রনাথও হেসে ফেললেন, "পাগলা বেগতিক দেখে পালালো।" পাগলামিই হোক বা খামখেয়ালি কাণ্ডকারখানা--কাকা-ভাইপোর কেউই কম যান না। সে এসরাজে সুর তোলাতেই হোক, স্বদেশিয়ানার হুজুগেই হোক, রাখী-বন্ধনেই হোক কিংবা শিল্প-সাহিত্য-নাটকচর্চাতেই হোক। সবেতেই কাকার দোসর ভাইপো। 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তখন নাটকচর্চার ধুম লেগেছে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রের কাল পেরিয়ে নাট্যচর্চার রাশ ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। আগেই গড়ে উঠেছিল 'ড্রামাটিক ক্লাব'। চেয়েচিন্তে তার জন্য ফান্ডও তৈরি হয়েছিল। তা, একদিন রবীন্দ্র-প্রস্তাবে সে ক্লাবের মৃত্যু হল, এবং অবনের প্রস্তাবে ফান্ডের টাকায় সেই ক্লাবের শ্রাদ্ধ হয়ে গেল। কাকা দিলেন নতুন সভাগঠনের প্রস্তাব, ভাইপো নাম দিলেন, "খামখেয়ালী সভা"। এ-ওর বাড়িতে ভোজসভা করাই ছিল মূলত এ-সভার কাজ। বলাবাহুল্য, সাহিত্যপাঠও হত। রবীন্দ্রনাথের 'বৈকুণ্ঠের খাতা'-নাটকটি এই সবারই ফসল। তা একদিন ঠিক হল, নাটকটি অভিনয় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ নিলেন 'কেদার'-এর পার্ট, আর অবন হলেন 'তিনকড়ি'। 

বলাবাহুল্য, নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই রবীন্দ্রনাথ অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিয়ে বসতেন। তার মধ্যে একটি বিশিষ্ট বিষয় ছিল, পার্ট ভুলে যাওয়া। নিজেরই লেখা নাটক, তবুও বিপত্তি যেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ফিরত। 'বৈকুণ্ঠের খাতা' অভিনয়ের সময় একবার তো মঞ্চে ঢুকে তিনি ভুলে একটা গোটা সিন বাদ দিয়ে ডায়লগ ধরে ফেললেন; অবন ভাগ্যিস ছিলেন স্টেজে, তিনি ফিসফিস করে সেটা ধরিয়ে দিতে নিজেই নাটকের লেখক কি না--তাই সামলে নিলেন। ব্যাপারটা সে-যাত্রা তেমন কেউ টের পেল না বলে লোকহাসাহাসির হাত থেকে রক্ষা পেলেন। 

তবে আর এক মজার ঘটনা ঘটেছিল এই নাটকের অভিনয়েই। সেবার নাটক দেখতে এসেছিলেন স্বয়ং গিরিশ ঘোষ। নাটকে অবন ঠাকুরের চ্যাংড়া ছোঁড়ার রোল। রংদার পোশাক। বুকে পানের পিকের দাগ। হাতে সন্দেশের হাঁড়ি। খেতে খেতে ডায়লগ। কিম্ভুতকিমাকার বেশে চরিত্রে তিনি এমন জমে গেলেন যে, কাকার লেখা ডায়লগ তো বললেনই সেইসঙ্গে এনতার বাই-ডায়লগ দিতে শুরু করলেন। চরিত্রে ঢুকে গেলে যা হয় আর কী! এদিকে রবীন্দ্রনাথ তো মহামুশকিলে পড়লেন, কিছুতেই ধরাছাড়ার খেই খুঁজে পান না! অথচ ভাইপোকে থামানোও যায় না। সে যাত্রায় টরেটক্কায় ভাইপোকে টেক্কা দিয়ে বেরোতে রবীন্দ্রনাথকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। তবে, ব্যাপারটা এত স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছিল যে, অভিনয় জমে একেবারে ক্ষীর হয়ে গিয়েছিল। নাটক শেষে গিরিশ ঘোষ তো ঘোষণাই করে বসলেন : "এ-রকম অ্যাকটার সব যদি আমার হাতে পেতুম তবে আগুন ছিটিয়ে দিতে পারতুম।"

"শারদোৎসব"-নাটকের সময় অবন আর রিস্ক নিতে চাইলেন না। দু'জনেরই বেশ বয়স হয়েছে তখন। ডায়লগ মনে থাকছে না কিছুতেই। তাই অবন প্রস্তাব দিলেন যে, এবার দু'জন প্রম্পটারকে স্টেজে তোলা হবে। তারা ডায়লগ এনতার কানে দিয়ে যাবে--তাহলেই ডায়লগ ভুলবার আর জো থাকবে না। কিন্তু, দু'দুটো লোক নাটকের খাতা হাতে স্টেজে পিছন পিছন ঘুরে বেড়াবে শুধুমাত্র ডায়লগ ধরিয়ে দেওয়ার জন্য--এটা কি ভালো দেখাবে? শেষ পর্যন্ত লোকে না হাসাহাসি করে! অবন কাকাকে অভয় দিলেন। তারপর ভেবে ভেবে বের করলেন এক দৃষ্টিনন্দন উপায়। ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দুই প্রম্পটারের জন্য মোটা কালো ও নীল কাপড়ের আগাপাশতলামোড়া পোশাক তৈরি করালেন। শুধু চোখের আর মুখের ফোঁকরটুকু রাখলেন। ভেতরে লোকগুলো নাটকের খাতা নিয়ে যাতে পড়ে যেতে পারে, তার ব্যবস্থা রাখলেন। 

শুরু হল নাটক। স্টেজের দুপাশে কাকা ও ভাইপোর পেছন পেছন ঘুরে নীল-কালো কাপড়মোড়া দুই প্রম্পটার ফিস ফিস করে ডায়লগ ধরিয়ে যেতে লাগল। ফলে, ডায়লগ ভুল হল না, অভিনয়ে সমস্যা হল না, ডায়লগ ধরিয়ে দেওয়ার ফিকিরটিও কেউ বুঝল না; উপরন্তু দর্শক দেখল দুই ছায়ামূর্তি যেন দুটো চরিত্রকে যমদূতের মতো অনুসরণ করছে--এটা নাট্যপরিস্থিতির সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গিয়েছিল যে, নতুন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করল। 

এক শ্রাবণে জন্ম অবনীন্দ্রনাথের; আর এক শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু। শুধু খামখেয়ালে নয় , শুধু সৃষ্টিশীলতায় নয়; শ্রাবণসূত্রেও এই দুই কৃতি দোসর...

তথ্যঋণ: ঘরোয়া- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাণী চন্দ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...