২৩ বছরের কিমিয়া অ্যালিজাদেহ। ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন কিমিয়া। দু’বারের সোনা জেতা চ্যাম্পিয়ন জেডি জোনসকে হারিয়ে।
কিমিয়া্র জয়ে তাইকোন্ডতে যে শুধু নতুন অধ্যায় শুরু হল তা নয়, পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের মনেও নতুন আলোর রেখা আঁকলেন কিমিয়া। কারণ তারা ঘরহীন। কিমিয়াও তাই।
কিমিয়া এবারের টোকিও অলিম্পিকে রিফিউজি টিমের সদস্য।
কিমিয়ার বাবা ইরানের কর্জে পেশায় দর্জি। কিমিয়া স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে থাকেন। নিজের পরিচয় হিসেবে তিনি বলেন, “ ইরানের বহু লক্ষ নির্যাতিত মহিলা যারা নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তিনি তাদেরই একজন”
২০১৬-র রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। ইরানের প্রতিনিধি হিসেবে। অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় ইরানের প্রথম পদকজয়ী মহিলা খেলোয়াড়।
রিও অলিম্পকে পদক জেতার পরই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। অতিমারীতে যখন গোটা বিশ্ব জুড়েই সমস্ত ধরনের প্রতিযোগিতা বন্ধ তখন তিনি নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবনা শুরু করেন। শেষপর্যন্ত অলিম্পিকে রিফিউজি টিম-এর প্রতিনিধি হয়েই অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
পৃথিবীর এগারোটি দেশ থেকে কিমিয়ার মতো ২৯ জন খেলোয়াড় এসেছেন টোকিও অলিম্পিকের আসরে। আফগানিস্তান, ক্যামারুন, ডেমক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, রিপাবলিক অফ কঙ্গো, এরিট্রিয়া, ইরাক, ইরান, দক্ষিণ সুদান, ভেনেজুয়েলা থেকে এসেছেন প্রতিযোগিরা।
কাতারের দোহাতে শিবির করে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
অলিম্পিক এবং প্রাক্তন ম্যারাথন প্রতিযোগী কেনিয়ার তেগলা লারোপ টোকিও অলিম্পিকে রিফিউজি প্রতিনিধি দলের শেফ-দ্য-মিশন।
অ্যাথলিট, ব্যাডমিন্টন, বক্সিং, সাইকেলিং, জুডো, ক্যারাটে তাইকোন্ড, শুটিং, সাঁতার, ভারত্তোলন, নৌ-চালনাসমেত তেরোটি বিভাগে অংশ নিচ্ছে এই দলের সদস্যরা।
ইন্টারন্যশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রধান টমাস বাক বলেছিলেন, ‘এঁদের কোনও দেশ নেই, জাতীয় সঙ্গীত নেই, পতাকা নেই। অলিম্পিকের অ্যান্থেমই বাজবে এঁদের সম্মানে। অলিম্পিকের পতাকার নীচে হেঁটে এঁরা ঢুকবেন স্টেডিয়ামে। এটা বিশ্বের সকল গৃহহীন মানুষের কাছে বার্তা, আপনারা আগে মানুষ। আপনারা সমাজের কাছে সম্পদ। হারিয়ে যাওয়ার নয়।’
২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকের সময় ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির এগজিকিউটিভ বোর্ড রিফিউজি অলিম্পিক টিমের অংশগ্রহণের বিষয়ে ছাড়পত্র দিয়েছিল। সেটাই প্রথমবার। অংশ নিয়েছিল ১০ জন ক্রীড়াবিদ। টোকিও অলিম্পিকে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৯।
রাষ্ট্রসংঘের নিয়মে উদ্বাস্তু স্বীকৃতি পাওয়া অ্যাথলিটদের নিয়েই তৈরি হয়েছে এই রিফিউজি অলিম্পিক টিম। আইওসি পরিচালিত অলিম্পিক রিফিউজি স্কলারশিপ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অ্যাথলিটরা নির্বাচিত হন। পারফরম্যান্স ছাড়াও, দেশ এবং লিঙ্গের মতো দিকগুলোও দেখা হয় নির্বাচনের সময়।
রিফিউজি অলিম্পিক টিমের অফিশিয়াল নাম ‘ইওআর’। কোনো বিশেষ কোনও দেশের পতাকা নেই। অলিম্পকের পতাকা আর অলিম্পিক আসরের মূল গানটিই তাঁদের নিজস্ব গান। এই দলটির যে কোনও ইভেনের শেষে বেজে ওঠে সেই গান।
প্রতিটাশ মুহুর্ত যেন বলে, নিজের স্বদেশ, নিজস্ব ভূমিখন্ড আমাদের পর করেছে কিন্তু এই বিশ্বভূম আমাদেরই জন্য। সেখানে জয় হয় প্রতিভার। তাই দিয়ে জয় করে নেওয়া যায় পৃথিবী।
সাঁতারু ইউসরা মার্দিনি রিও অলিম্পিকের প্রাক্কালে বলেছিলেন, “ এই দলের সকলের অনুভূতিটা একই রকম। জীবনে যাই ঘটে যাক কোনভাবেই হাল ছাড়া চলবে না। আমাদের সবাইকে অনেক বিপর্যয়ের মুখোমুখী হতে হয়েছে, কিন্তু তবু আমরা এগিয়ে চলেছি কারণ আমাদের স্বপ্ন আছে...”
এখনও এই কথাগুলোই এই দলের এক হওয়ার শেষ কথা।
খেলার মাঠ আর লক্ষ লক্ষ ভাঙ্গা বুকের মানুষের মনে ঘুরে দাঁড়াবার আশার আলো জ্বেলে দিয়েছেন ওঁরা। উদ্বাস্তু জীবনের অন্ধকার ঠেলে অদম্য জেদ আর খেলার প্রতি ভালোবাসার জয়।
সম্প্রতি টোকিও অলিম্পিকে গেমস ভিলেজের সামনে একটি ম্যুরালে সই করেন রিফিউজি দলের সদস্যরা। তাঁরা জানিয়েছেন, “এভাবেই খেলাধূলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে চান তাঁরা। এই মঞ্চ তার আদর্শ জায়গা।”