একদিকে তীর-বল্লম। অন্যদিকে আগ্নেয়াস্ত্র।শেষ রক্ষা কি আদৌ সম্ভব!সমুদ্রে ভেসে বেরাচ্ছেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস।জাহাজের নাম সান্তা মারিয়া। চোখে স্বপ্ন ভারতবর্ষ আবিস্কারের ।কাবার করে ফেলেছেন ঊনষাট দিন। ক্লান্তি চাইছে একটু বিশ্রাম। জাহাজের বাকিদেরও একই মত।অগত্যা!মনে ধরল বিস্তীর্ণ এক সমভূমি।সেখানে রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা। লম্বা-ঘন প্রেইরি ঘাস। বিস্ময় গ্রাস করল পৃথিবীর স্টার নাবিককে। মুগ্ধ হলেন কলম্বাস। সঙ্গীদের নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়লেন।
নতুন অতিথি সৎকারে নিজেদের উজার করে দিয়েছিল সেই অচেনা দ্বীপের বাদামি ও কালো চামড়ার বাসিন্দারা।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই আতিথেয়তায় মজে উঠেছিলেন ক্রিস্টোফার।স্পেনের রানী-কে চিঠিতে জানান যে এদের মত ভালো জাতি আর নেই।এরাই আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠী `রেড ইন্ডিয়ান`।কলম্বাস পথ ভুলে এসে পড়েছিলেন এই সৌন্দর্য ও বিস্ময়ে ঘেরা উত্তর আমেরিকার দ্বিপে। ইন্ডিয়া ভেবে নাম দিয়ে ফেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিস। আর মানুষগুলি হয়ে যায় রেড ইন্ডিয়ান।যুদ্ধে বা শিকারে যাওয়ার আগে মুখে মাখিয়ে নিতেন লালচে তরলে । সম্ভবত, কলম্বাস সেই রূপ দেখেই এদের নামকরণ করেছিলেন রেড ইন্ডিয়ান।শিকার, পশুপালন ও কৃষি ছিল এদের জীবিকা।
তারা ছিল বহু গোত্রে এক জাতি। বর্ণবিদ্বেষী শ্বেতাঙ্গদের সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতা সহ্য করতে পারেনি প্রকৃতির এই সন্তানরা।কলম্বাস আবিষ্কৃত এই নতুন দ্বীপে পড়ল শকুনের নজর। ইউরোপীয়দের। শুরু হয় কলোনাইজেশন তথা বসতিস্থাপন, জবরদখল, হত্যা ও লুণ্ঠন। অস্তিত্ব বাঁচাতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রেড ইন্ডিয়ানরা।বিচিত্রতায় ভরপুর এই আদিম জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ব্যহত হয় আগ্রাসী শ্বেতাঙ্গদের লোলুপ দৃষ্টিতে।গোষ্ঠী বিবাদ কে অস্ত্র করেই শ্বেতাঙ্গরা তীর ছুঁড়ল এই উপত্যকায়। ভেঙে পড়তে লাগল বুনিয়াদ।জাতির জনক ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ‘রেড ইন্ডিয়ান’ দের সভ্য করার ক্ষেত্রে অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন।কিন্তু ১৮৩২ সালে অ্যান্দ্রু জ্যাকসন দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।আর তিনিই হলেন কাল।১৮৩০ সালে কংগ্রেসে উত্থাপিত হল ‘ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্ট’। উপজাতি নিশ্চিহ্ন করার শেষ পেরেকটা পুতে ফেলা হল। প্রেসিডেন্ট অ্যান্দ্রু জ্যাকসনের এই 'আদিবাসী উৎখাত নীতি' আজও পরিকল্পিত জাতিগত হত্যাকাণ্ডের এক ঘৃণ্য নিদর্শন হয়ে আছে।বেশ কিছু জনগোষ্ঠী বিক্ষিপ্ত ভাবে সংগঠিত হয়ে উল্গুলানে নামে। একে একে ব্যর্থ হয়ে যায় আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধের যাবতীয় চেষ্টা।
সভ্য জগতের হিংস্র মানুষগুলোর কাছে প্রতিরোধের সব চেষ্টা হয় একে একে ব্যর্থ । আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে ‘উ্যনডেড নি’ পার্বত্য খাড়ির বাঁকে।১৪৯২ থেকে ১৮৯০। দীর্ঘ ৪০০ বছর চলেছিল অস্তিত্ব ও মানভূম রক্ষার সংগ্রাম।এভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের আমেরিকা দখল করে নেয় ইউরোপীয়রা। নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু আদিবাসী অনেক দিন বন বাদাড়ে লুকিয়ে থেকে জীবন ধারণ করে।তবে তারাও ধীরে আধুনিক আমেরিকার জীবনযাত্রায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে। চরম অন্যায় আর অবিচারের গ্লানি বুকে করে আজ তারা পরাভূমের অধিবাসী।রেড ইন্ডিয়ানদের এই করুণ বাস্তবতা নিয়ে বিখ্যাত লেখক ডি ব্রাউন রচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত বই `বারি মাই হার্ট এট উনডেড নি`। বাংলা তর্জমায় ‘আমারে কবর দিও হাঁটু ভাঙার বাঁকে’।আদিবাসী আন্দোলনের এরকম টুকরো খতিয়ান ইতিহাসের পাতায় পাতায় মুখ লুকিয়েছে। সভ্যতার বর্বরতা না কি সভ্যতার চাহিদা!