সুধীরলাল চক্রবর্তী এবং পান্নালাল ঘোষ, - এঁরা কারা? এ প্রজন্মের মুখ ফস্কে আজ এই প্রশ্ন বেরিয়ে আসাটাই স্বাভাবিক। কারণটা খুব সহজ। কারণটা হল শিক্ষা-সংস্কৃতি-রুচি-অর্থনৈতিক-সামাজিক দিক পরিবর্তন। স্বাভাবিকভাবে সময়ের হিসেবে প্রয়োজন মতো একটা সময়ের পর সবকিছুরই একটা বদল আসে, আমরা নতুনত্বের সঙ্গে এগিয়ে চলি, তাই তো হওয়ার। কিন্তু এখন লক্ষ্য করা যায় 'চলতি' হাওয়াটা যেন নতুনত্ব আর নতুনত্বের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে। শুধু নতুন প্রজন্ম কেন, কেউই কি আর পুরনো কিছু মনে রাখতে চায়? যাঁরা চাইছে তাঁরা কি 'সংখ্যালঘু'? ভাষা-ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা বুজরুকি নাকি?
প্রশ্নই বোধহয় সময়ের সবথেকে প্রাসঙ্গিক গন্তব্য, তা উঠছে, উঠবেও। আমি সেই সংখ্যালঘুদের দলে তাই আবারও মনে করিয়ে দেব ঘটে যাওয়া কিছুকে এবং মনে করার দায় কারো নেই জেনেও আজ আলোচনা এবং স্মরণ করছি বাংলার দুই কিংবদন্তী সঙ্গীতসাধক, 'সুধীরলাল' গাইন এবং 'পান্নালাল' বাইন -কে।
'সুধীরলাল' গাইন
বাংলা গানের 'লিভিং লেজেন্ড' কবীর সুমনের মতে "সূক্ষ্ম অলংকারসমৃদ্ধ আধুনিক সুররচনায় কাজী নজরুল ইসলাম ও হিমাংশু দত্তর পর তিনিই শেষ সম্রাট।"
সুধীরলাল চক্রবর্তী বাংলা ভাষার অত্যন্ত গুনী সুরকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও গায়ক। তাঁর বাবা ছিলেন সুপণ্ডিত ও সংগীতরসিক ব্যক্তি, তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসতো। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বাড়ি্র এই 'গান-গান' আবহাওয়াই হয়ে ওঠে সুধীরলালের সঙ্গীত চর্চার অনুপ্রেরণা।
মোটামুটি তিরিশের দশকে সুধীরলাল চক্রবর্তীর জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে। তাঁর বাবা গঙ্গাধর চক্রবর্তী ছিলেন কালেক্টর অফিসের কর্মী। কিশোর সুধীরলাল কলকাতায় এসে তৎকালীন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতাচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর শিষ্যত্ব পান। শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি সুর রচনাতেও তাঁর যথেষ্ট উৎসাহ ছিলো। সেখানে তিনি পাঁচ বছর তালিম নেন।
বিশ শতকের আধুনিক বাংলা গান, রাগপ্রধান, গজল, ঠুমরী প্রভৃতি গানে পারদর্শী এবং একজন সুদক্ষ সুরকার তিনি। ১৯৪৩-৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারকেন্দ্রের সংগীত পরিচালক। তাঁর গান আত্মপ্রকাশ করে মূলত গ্রামোফোন ও বেতারের কল্যাণে এবং তা আরো বিস্তৃত হয় চলচ্চিত্র ও নানা অনুষ্ঠানের মঞ্চ-পরিবেশনায়। তখনকার দিনে তাঁর পরিবেশনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার সেইসব গান ছিল প্রধানত কাব্যধর্মী এবং সুর রাগাশ্রয়ী।
তাঁর কাছে শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন, নীতা সেন এবং আরও অনেক সংগীতশিল্পীরা তালিম নিয়েছিলেন। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের বুকে ঝরে, মাকে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে’ গানটি বিপুল জনপ্রিয় ছিল সেসময়।
'কালি ও কলম' পত্রিকায় আবুল আহসান চৌধুরীর লেখায়, "প্রায় শুরু থেকেই বাংলা গানের ক্ষেত্রে গ্রামোফোনে ছিল মূলত ভক্তিগীতির প্রায় একক প্রভাব। পরে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত, কিছু পরে অতুলপ্রসাদ এবং আরো পরে নজরুলের গান গ্রামোফোনে-বেতারে-মঞ্চে-আসরে-বাসরে পরিবেশিত হতে থাকে। বাংলা গানের এই পরম্পরায় আধুনিক গানের আবির্ভাব ঘটেছে। এর পেছনে নজরুলের একটা সরাসরি প্রভাব ও প্রেরণার কথা কবুল না করে উপায় নেই। গানের বাণী-সুর ও গায়নশৈলীতে একটা স্পষ্ট পরিবর্তন এলো। গীতিকার, সুরস্রষ্টা ও গায়ক যাঁরা এলেন – পঞ্চকবির পরে তাঁরা নতুন এক গানের যুগ সৃষ্টি করলেন – বাংলা গানের ক্ষেত্রে তার ফল হলো দূরপ্রসারী ও স্থায়ী এবং বিকশিত হলো গানের এই ধারা। নজরুলের সমসময়ে গান রচনায় এগিয়ে আসেন যাঁরা, কেউ তাঁর বন্ধু, কেউ সংগীত-সতীর্থ, কেউবা স্নেহভাজন অনুজপ্রতিম – তুলসী লাহিড়ী, হীরেন বসু, অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ, প্রণব রায়, শৈলেন রায় প্রমুখ এবং আরো কিছু পরে পবিত্র মিত্র ও মোহিনী চৌধুরী এবং এইসব গান গাওয়ার জন্যে কিছু শিল্পীও তৈরি হয়। সুর-যোজনায় নিমগ্ন হন পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেববর্মন, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, দুর্গা সেন, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সুবল দাশগুপ্ত এবং আরো কেউ কেউ। নতুন চেতনা-মেজাজ-রুচিতে সিক্ত হয়ে যে আধুনিক বাংলা গানের জন্ম হলো – তার রূপায়ণে বৈশিষ্ট্য-বৈচিত্র্য-আবেদন-লোকপ্রিয়তার নিরিখে যেসব শিল্পীর নাম করতে হয় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কানন দেবী-কমলা ঝরিয়া-যূথিকা রায়-জগন্ময় মিত্র-সুধীরলাল চক্রবর্তী-রবীন মজুমদার-সত্য চৌধুরী-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।"
মোটে বত্রিশ বছরের জীবন তাঁর, ১৯২০-এ জন্ম এবং ১৯৫২'র ২০ এপ্রিল বিদায়। ওটুকু সময়েই বুঝিয়েছিলেন গানের ভুবন ভরিয়ে দেওয়ার কতটা উপযুক্ত ছিলেন তিনি।
'পান্নালাল' বাইন
দীর্ঘ কাল বাঁশি আকারে ছিল ছোট। স্থান ছিল প্রধানত পল্লিসংগীতে। এক বঙ্গসন্তান সেটিকে দিলেন নতুন রূপ, নিয়ে গেলেন আবিশ্ব ধ্রুপদী সংগীতের আসরে। পৃথিবীর প্রথম ৩২ ইঞ্চি লম্বা, সাতটি ছিদ্রযুক্ত বাঁশের বাঁশি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কৈশোরেই জড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য জন্মস্থান বরিশাল থেকে ১৯২৬ সালে কলকাতায় পালিয়ে আসা পান্নালাল ঘোষ বাঁশিকে করে তুলতে পেরেছিলেন ‘কনসার্ট’ যন্ত্র বা সেতার সরোদ সানাই সারেঙ্গির সমান, অর্থাৎ ধ্রুপদী সংগীতের আসরে যা একক গরিমায় বাজতে পারে মূল যন্ত্র হিসেবে।
পান্নালাল ঘোষ সম্বন্ধেও কবীর সুমন লিখেছেন, "সারা দুনিয়ায় যাঁর স্থান একেবারে ওপরের সারিতে সেই মহাশিল্পী ছিলেন আশ্চর্য সরল প্রকৃতির। আমার বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা:
কলকাতার অক্রুর দত্ত লেনে হিন্দুস্তান রেকর্ডসের স্টুডিয়োয় তরুণ সুধীন্দ্রনাথ গ্রামোফোন রেকর্ড করছেন। শৈলেশ দত্তগুপ্তর সুরে বাংলা গান ও রবীন্দ্রনাথের একটি গান। রিহার্সাল চলছে। এমন সময়ে রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার এসে জানালেন – নিজের কাজে স্টুডিয়োয় এসে পান্নালাল ঘোষ মনিটরে সুধীন্দ্রনাথের গলা ও গান শুনে বায়না ধরেছেন এই তরুণ শিল্পীর সঙ্গে তিনি বাঁশি বাজাবেন। - তখন ব্রিটিশ আমল। স্বয়ং বড়লাট হঠাৎ এসে হাজির হলেও শিল্পীরা অতো অবাক হতেন না। - পান্নালালের তর সইছিল না; তিনি ঢুকে পড়লেন স্টুডিয়ো ফ্লোরে। হাত জোড় করে বললেন, “আমায় একটু বাজাতে দিন”। সেশন-বাঁশিশিল্পীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন, তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করলেন বাঁশির দেবতা। বাবার প্রায় হার্ট এটাকের উপক্রম। সেশন-বাঁশিশিল্পী পান্নালালের পা ছুঁয়ে বললেন – “আমরা ধন্য”। পান্নালাল বাবার কাছেও অনুমতি চাইলেন। বয়সে এমন কিছু বড় ছিলেন না তিনি বাবার থেকে, তাও বাবা তাঁকে প্রণাম করলেন।
পান্নালাল তো আর সঙ্গে বাঁশি আনেননি, এসেছেন অন্য কাজে। সেশন-শিল্পীর কাছ থেকে তাঁর বাঁশিটি চেয়ে নিলেন পান্নালাল। - সে-যুগের রেওয়াজ ছিল – রেকর্ডিং-এ বাঁশি গোটা গানটাই বাজাতো কন্ঠশিল্পীর সঙ্গে। - সুধীন্দ্রনাথ আমায় বলেছিলেন – পান্নালাল কিন্তু তা করলেন না। কেবল প্রিলিউড ও ইন্টারলিঊডে বাজালেন তিনি। - সুধীন্দ্রনাথ বলতেন, “গাইব কী। লোকটা যেভাবে গুনগুন করে, প্রায় ফিসফিস করে বাজাচ্ছে বাঁশিটা যে আমার গলা দিয়ে তারপর গান আর বেরোচ্ছে না”।
সেই গ্রামোফোন রেকর্ডের লেব্ল্-এ লেখা উল্লেখ করা হয়েছিল – বাঁশিতে পান্নালাল ঘোষ।
সারাজীবন সুধীন্দ্রনাথ কতোবার যে বলে উঠেছেন, 'ভেবে দ্যাখ্, খোদ পান্না ঘোষ যেচে বাঁশি বাজিয়ে দিলে রে! ও তো মানুষ না রে, দেবতা। যেচে, গায়ে পড়ে বাজিয়ে দিলে! জীবনে এটাও ঘটে গেল'।"
এইরকমই কত মনিমুক্ত কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর আর তাঁর বাঁশির মহানুভবে। রাগসঙ্গীতের গভীর আবেগ