“বাবু তুমি কেমন আছ? তোমার কথা খুব মনে হয়…”
হাতের লেখার ধাঁচকে ঠিক মুক্তাক্ষর বলা যায় কিনা ধন্দে পড়তে হয় পাঠককে। ঈষৎ জড়ানো টানা টানের বাংলা। বোঝা যায় কলম ছুটেছে বেশ তাড়াতাড়ি। কাটাকাটি নেই। পরিচ্ছন্ন। ঝরঝরে।
শেষের সইটি দেখলে বোঝা যায় শিল্পীর হাতের স্বাক্ষর।
এভাবেই চিঠি লিখতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্রেরকের নাম সত্যজিৎ রায়।
তখনও সুলভ হয়নি টেলিগ্রাম। চল্লিশের দশকে ছাত্র হলেন কলাভবনের। কলকাতা থেকে সোজা শান্তিনিকেতন। আশ্রম আলো করে আছেন রবি ঠাকুর। অবন ঠাকুর। নন্দলাল।
শান্তিনিকেতন আশ্রম থেকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন মাকে। বাবাকে হারিয়েছেন দু বছর চার মাস বয়সে। মা সুপ্রভা রায়ের কাছেই মানুষ। কড়া শাসনের আগল ছিল অনেক দিন সুপ্রভা দেবী ঝাড়গ্রামের বিদ্যাসাগর বাণীভবনে সূচিকর্ম শেখাতেন।
মা-ছেলের মধ্যে চিঠিপত্র চলত। সেভাবেই একে অপরের খেয়াল রাখা। ব্লাড প্রেসার বাড়ল কি, ওষুধ কেমন চলছে, ইনজেকশন বাদ পড়েনি তো!
সত্যজিতের আশ্রম জীবন, মাস্টারমশাইদের কথা আসত চিঠিতে।
কলকাতা থেকে দূরে গিয়ে ক্রিকেট আর সিনেমা দুই-ই বাদ পড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। আর পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মাকে সে কথাও লিখেছেন মানুক।
সত্যজিতের চিঠির একটা বড় বৈশিষ্ট্য সব চিঠিতেই তিনি কোথায় থাকছেন, সেও জায়গা কেমন খুঁটিনাটি বৃত্তান্ত লিখতেন। চিঠির এক চিলতে পাতাতে উঠে আসত গোটা জায়গাটা।
পরবর্তী সময়ে জীবনের পরিধি যত বেড়েছে তত বেড়েছে চিঠিপত্রের পরিধিও। সিনেমা হয়ে উঠেছে চিঠি চর্চার বিষয়।
বাড়িতে থাকলে অনেকটা সময় তিনি কাটাতেন চিঠিপত্রে। জরুরি চিঠি লেখার আগে খসড়া করে নিতেন। বাকি ক্ষেত্রে সেসবের প্রয়োজন হত না।
প্রফেসর শঙ্কু লেখার আগে বিদেশে থাকা বন্ধুদের চিঠি লিখে জানতে চাইতেন বিভিন্ন জায়গা নিয়ে। উত্তর এলে তবেই চলত গল্পের লেখনী।
তাঁর চিঠির ভাষা তাঁর সিনেমার মতোই ঝরঝরে। একটাও বাড়তি শব্দ নেই।
যখন বিলেতে চাকরি করছেন তখনও নিয়মিত চিঠি লিখতেন মাকে। সেসব চিঠি শুধু খবরাখবরের চিঠি হয়ে থাকেনি হয়ে, কলমের গুণে হয়ে উঠেছিল খুদে ট্রাভেলগ।
পরবর্তী সময়ে ছেলেকে চিঠি লিখতেন। ধরনে এতটুকু বদল নেই। দশ বছরের ছেলের প্রতি স্নেহময় পিতার অনুভূতি।
সম্প্রতি তাঁর বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে পাওয়া গিয়েছে সত্যজিতের অপ্রকাশিত চিঠি। গত লকডাউনে পুত্র সন্দীপ রায় সন্ধান পেয়েছেন অনাবিষ্কৃত সত্যজিতের। আগামীদিনে সত্যজিৎপ্রেমীদের জন্য প্রদর্শনীর ভাবনাও চলছে।
তাঁর জন্ম শতবর্ষে রায়পরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার।