"এতখানি জীবনে সব ছেড়ে- ছুড়ে যদি সেতার নিয়েই পড়ে থাকতাম তা হলে হয়তো বিরাট এক সেতারী হতাম। যৎকিঞ্চিৎ যাই বাজাই, আমার কপাল ভাল, গুরুদেবের আশীর্বাদ আছে, সারা জগতে কত সমাদর পেলাম, লোকেরা ভালবেসে শুনতে আসে, আমিও ভালবেসে ঢেলে দিই যা আছে আমার কাছে। আমি কিন্তু জানি, আমি কি এবং কোথায়"।নিজের সম্বন্ধে এমন কথা বলেছিলেন রবিশঙ্কর। যাঁর সুরের ছোঁয়ায় বিশ্ব আলোড়িত হয়েছে, পাশ্চাত্যে যিনি পৌঁছে দিয়েছেন ভারত- আত্মার হৃদয় নিংড়ানো সুর মাধুরী, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রূপলাবণ্য আর গভীরতা সেই শিল্পী জীবনের এক বিশাল সময় পার হয়ে এসে এই নিরভিমান আত্মবিশ্লেষণে বুঝিয়ে দেন তাঁর স্বাতন্ত্র্য। তিনি রবিশঙ্কর। তিনি স্বভাবত স্বতন্ত্র।
১৯২০ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে বেনারসে জন্ম রবীন্দ্রশঙ্কর চৌধুরীর। তাঁরা চারভাই। সবার বড় উদয়শঙ্কর।সারা জীবন যাঁর প্রতি রবিশঙ্করের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল অটুট। বাবা শ্যামশঙ্কর চৌধুরী ছিলেন আইনজ্ঞ ও সঙ্গীতরসিক। মা হেমাঙ্গিনী দেবীও ছিলেন সুগায়িকা। সবার ছোট ' রবু'-র ওপরে মা-র প্রভাব ছিল গভীর। তিনি নিজেই বলেছেন, "My mother was very much attached to me....She had the opportunity to hear all the famous women singers of the time and I remember even from my very early years she used to sang lullabies to me in her soft melodious voice- the very beautiful old melodies and classical songs or songs from dramas. Many of these songs, I learned by heart and some of them I still enjoy singing".
বাবাকে কাছে না পাবার যন্ত্রণা ছিল তাঁর আজীবন, "নিজের বাবার ভালবাসা তো জীবনে পাইনি। তাঁর সঙ্গই তো সে অর্থে পাইনি কখনও। হিসেব করলে হয়তো সারা জীবনে দেড় মাস কি দু-মাস ওকে কাছে পেয়েছিলাম। তাও খেপে খেপে। একনাগাড়ে নয়"। তাঁর আট – ন বছর বয়েসের সময় মেজদা রাজেন্দ্রশঙ্করের এক বন্ধু তাঁকে বেশ কিছু গান শিখিয়েছিলেন, যার মধ্যে কিছু গান ছিল রবীন্দ্রনাথের, যে গানগুলি বাড়িতে কোন অতিথি এলে তিনি গেয়ে শোনাতেন। কাশীতে থাকার ফলে ছোট থেকেই সংস্কৃত স্ত্রোত্র তিনি শুনেছেন। শুনেছেন নানান ধরনের সঙ্গীতও।
১৯৩০ সালে মা হেমাঙ্গিনী দেবীর সঙ্গে রবিশঙ্কর পৌঁছলেন প্যারিসে। উদয়শঙ্কর তখন সেখানে ছিলেন। রবিশঙ্করকে ভর্তি করে দেওয়া হল সেখানকার এক ক্যাথলিক স্কুলে।যখন তাঁর বারো বছর বয়েস তখন থেকেই দাদা উদয়শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। এই সময় তিনি বহু বিখ্যাত শিল্পীদের অনুষ্ঠান শুনেছেন-" প্যারিসে থাকাকালীন প্রায়ই বিরাট বিরাট সব মিউজিশিয়ানদের শুনতে যেতাম। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপও হয়েছিল।
যেমন ফ্রিৎজ ক্রাইসলার। পৃথিবীতে ততদিন বেহালার বাজনা জীবিত থাকবে ততদিন ওঁর নাম কারও ভোলা সম্ভব নয়।হাইফিত্জও তখন পুরোদমে বাজাচ্ছেন।...হাংগেরীয় বলে ওঁর হাতে একটা অদ্ভুত জিপসি টাচ ছিল"। এঁদের গান, বাজনা রবিশঙ্করের কিশোর মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করেছিল। এই সময়েই তাঁর সঙ্গে ইহুদি মেনুহিন ও তাঁর গুরু জর্জ এনেস্কোর আলাপ হয়।
উদয়শঙ্করের গ্রুপে রবিশঙ্কর নাচতেন ও সেতার বাজাতেন। নাচের চর্চা ছিল তাঁর অনেকদিন পর্যন্ত। এমন কি আলাউদ্দিন খাঁ তাদের ট্রুপে যোগ দেবার পর এক "ব্যালেতে আমার মিনিট আড়াইয়ের একটা কথ্থক নাচের টুকরো ছিল। ভাবতে পারো, বাবা তাতে ব্যাকগ্রাউন্ডে ঝাঁপতালের ওপর তবলার সঙ্গে বাংলা ভোর বাজাতেন"।
নাচ থেকে সরে এলেন নিজেই। মজে গেলেন সেতারে। এনায়েত খাঁ সাহেবের কাছে সেতার শেখার কথা অনেক দূর এগিয়ে ছিল রবিশঙ্করের। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল তাঁকে। এনায়েত খাঁ- র কাছে শেখা আর হল না। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, "Perhaps it was coincidence but it seems to me that I was not meant to become his disciple....Indeed it was later in that very year, in the All Bengal Music Conference that I first met Allauddin Khan, the man who was to become my guru." কিছু দিন পরে আলাউদ্দিন খাঁ যুক্ত হলেন উদয়শঙ্করের দলে। তাঁর প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর বলেছেন, "বাবাকে প্রথম দেখি সেই ১৯৩৪-এ সেনেট হলে।
তার আগে তিমিরদার মুখে শুনে শুনে আমার একটা ধারণা হয়েছিল যে, উনি অত্যন্ত রাগী মানুষ, বিরাট নীতিবাগীশ। কাজেই প্রথম সাক্ষাৎ থেকে বেশ ভয়াবহ মনে হয়েছিল। পরে উনি যখন ১৯৩৫ সালে দাদার ট্রুপে যোগ দিয়ে বোম্বে এলেন, আলি আকবর তখন ছোট্ট ছিল, বছর তেরো বয়েস।.....তখন দেখলাম বাবার অন্য একটা রূপ"। রুদ্রমূর্তি ধরতেন আলি আকবরকে শেখানোর সময়। সেই দেখেই রবিশঙ্করের আতঙ্ক লাগত।
সেই বছরের "......ডিসেম্বরের শেষাশেষি আমাদের জাহাজ ছাড়ল, মা তখন ডকে আমাদের দেখতে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। যখন আমি ওঁকে প্রণাম করলাম, আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর হুহু করে কাঁদলেন। বাবাও ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাবার হাতটা ধরে আমার হাতটা তার মধ্যে দিয়ে মা বললেন, দেখবেন এই ছেলেটাকে আমার। ওর বাবা এই কিছু দিন হল মারা গেছেন। আজ থেকে আপনিই ওর বাবা। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার হাতেই ওকে ছেড়ে দিলাম"। এরপর আলাউদ্দিন খাঁ-র চোখেও জল এসে গিয়েছিল। হেমাঙ্গিনী দেবীর এই সমর্পণের কথা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব কোনদিন ভোলেন নি।
"ঐ কান্নাকাটি দিয়েই বলতে গেলে আমার বাবার সঙ্গে আসল সম্পর্কের শুরু"। জাহাজেই শুরু হল তালিম। এরপর বিদেশ ঘুরে শেষ পর্যন্ত মাইহার। গুরুগৃহবাস। "....বাবার কাছে এই জিনিসটাই আমি দেখলাম যে, ওঁর কাছে শেখার এত আছে যে, ওঁকে সমুদ্রের সঙ্গেই তুলনা করা চলে"। একজন দিয়েছেন হৃদয় উজাড় করে, অন্যজন নিয়েছেন হৃদয় ভরে।তালিমে কখনও ফাঁকি দেন নি তিনি। "সেই '৩৮ সাল থেকে '৪১ পর্যন্ত শিক্ষাদীক্ষাই চলেছিল'। মাইয়ারে থাকাকালীন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বকুনিতে রাগ করে চলে আসতে চেয়েছিলেন রবিশঙ্কর। আটকে ছিলেন 'আলু ভাই'-আলি আকবর। পরে সব শুনে আলাউদ্দিন খাঁ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মা- র কথা, রবিশঙ্করকে 'বাবা'-র হাতে সঁপে দেবার কথা। সারাজীবন এই ভালোবাসার বন্ধন কখনও শিথিল হয়নি।
সম্ভবত এই স্নেহের টানেই অন্নপূর্ণার সঙ্গে বিবাহ হয় রবিশঙ্করের। "১৯৪১ সালে আলমোড়ায় আমাদের বিয়ে হল।.... তখন আমার একমাত্র ধ্যান বাবার ভালোবাসা পাওয়া। আমরা যে এক ঘরের লোক, সঙ্গীতের সাধক সেই সম্পর্কটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল'। অন্নপূর্ণার বয়েস তখন পনেরো আর রবিশঙ্করের একুশ। বিয়ের পরেও থাকতেন মাইহারে, চলত তালিম। জন্ম হল তাঁদের একমাত্র সন্তান শুভেন্দ্রশঙ্করের।
কিছু দিন পরে রবিশঙ্কর অন্নপূর্ণা এলেন বোম্বেতে। কাজের সন্ধানে। যুক্ত হলেন আই. পি. টি. এ-র সঙ্গে। রেবা রায়চৌধুরীর লেখায় ধরা আছে সেদিনের স্মৃতি। "১৯৪৫-র শেষে কি '৪৬-এর গোড়ায় হঠাৎই রবিশঙ্কর আমাদের স্কোয়াডে এসে যোগ দিলেন।...রবিশঙ্কর আলাউদ্দিন খাঁ-র কন্যা অন্নপূর্ণাকে বিবাহ করেছিলেন। এমন অমায়িক গুণী মহিলার সংস্পর্শে আমি কোনও দিন আসিনি।
রবিশঙ্কর আর অন্নপূর্ণা বউদির সাত- আট ঘন্টা একনাগাড়ে একাত্ম হয়ে রেওয়াজ শুনবার পর নিজেদের তিরস্কার করতাম।.... রবিশঙ্কর যখন প্রথম এলেন, তখন সে কী অবস্থা। তাঁর থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার জায়গা নেই। তখন এই রকমই একটা ঘরে রবুদা থাকতেন, স্ত্রী আর বাচ্চা ছেলে নিয়ে। নিজের কাপড় নিজে কাচছেন, বাসন মাজছেন"। আই. পি. টি.এ-র আদর্শের প্রতি রবিশঙ্কর কোনও টান অনুভব করতেন কি না জানা নেই তবে অনেক পরে একবার বলেছিলেন, "আই. পি. টি.এ-র প্রথম দিকটায় তিন- চার বছর কি যে ভাল কাজ হয়েছে কি বলব"।
এই সময় রবিশঙ্কর সুর দিলেন ইকবালের অমর রচনা 'সারে যঁহা সে অচ্ছা'-য়। ব্যালের জন্য তৈরি করলেন সুর। সঙ্গীত পরিচালনা করলেন একাধিক চলচ্চিত্রে। 'ধরতি কি লাল', 'নীচা নগর' ইত্যাদি। বাইরের জগতে যখন আলো আসছে ঘরে তখন ঘনিয়ে উঠছে অন্ধকার। দুই গুণী শিল্পীর জীবন বয়ে যেতে লাগল দুই খাতে। যে শিল্পী সম্বন্ধে গুণীজনেরা বলেছেন যে আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বাজনার শতকরা আশি ভাগ পেয়েছিলেন অন্নপূর্ণা, তিনি নিজেকে সরিয়ে নিলেন বাইরের জগত থেকে। অনুষ্ঠান করা থেকে সরে গেলেন চিরদিনের জন্য।
রবিশঙ্করের জীবন থেমে থাকল না। তবে অন্নপূর্ণা প্রসঙ্গে তাঁর শ্রদ্ধা ছিল চির অমলিন। "এই অন্নপূর্ণার সঙ্গে আমি শেষ পর্যন্ত মিলে-মিশে থাকতে পারিনি ঠিকই কিন্তু ওর মাধ্যমে আমার প্রকৃত ভাল হয়েছিল।.... রেওয়াজ, রেওয়াজ আর রেওয়াজ এইভাবেই সে সময়ের সে জীবনটা চলেছিল। সেটা না করলে সঙ্গীতে এগোতে পারা আমার পক্ষে মুশকিল ছিল; কারণ তার আগে দাদার ট্রুপে থেকে আমি প্রায় বখে যেতে বসেছিলাম"। অন্নপূর্ণা ছেলেকে নিয়ে চলে গেলেন মাইহার।
১৯৪৯ সালে রবিশঙ্কর সঙ্গীত পরিচালক পদে যোগ দিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে। ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের 'অপু' ট্রিলজি- পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসারে সঙ্গীত পরিচালনা করলেন রবিশঙ্কর। কালজয়ী কাজ। ১৯৫৪ -তে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে এক অনুষ্ঠানে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অপরূপ সৌন্দর্য তুলে ধরলেন পাশ্চাত্য জগতের কাছে। শুরু হল তাঁর জয়যাত্রা। 'বাবা' আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের তালিম, রবিশঙ্করের শেখার আগ্রহ, রেওয়াজে জোর- সব মিলেমিশে এক আশ্চর্য শিল্পীর আবির্ভাব দেখল বিশ্ব। কৈশোর থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীত জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ থাকায় তিনি জানতেন পশ্চিম কি চায়। পূর্ব দিগন্তের সুর তাই পশ্চিমী ঝঞ্ঝায় উড়ে গেল না। তপোবনের শান্তিধারা ঝরে পড়ল পশ্চিমী দুনিয়ার উন্মাদনার ওপর। অভ্রভেদী রথে ধ্বজা উড়িয়ে তরুণ শিল্পী বিশ্বকে শোনালেন ভারতশিল্পের জয়গান।
১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠান করলেন আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশে। পেলেন প্রবল জনপ্রিয়তা। লন্ডন থেকে প্রকাশিত হল তাঁর বাজনার রেকর্ড। ১৯৫৮- তে প্যারিসে ইউনেস্কো সঙ্গীত উৎসবে বাজালেন। ছোটবেলায় যখন প্যারিসে ছিলেন তখন তিনি ভেবেছিলেন, "I have felt a strong desire all most like a missionaries zeal to bring the beautiful rich and ancient heritage of our classical music to the West and to bring a deeper comprehension and appreciation of it".
নিজের বাজনায়, নিজের সাধনায় সেই ইচ্ছেকে তিনি সত্য করে তুললেন।১৯৬৫-তে 'বীটলস'-এর জর্জ হ্যারিসন এলেন রবিশঙ্করের কাছে সেতারের তালিম নিতে। ১৯৬৭-তে পূর্ব পরিচিত ইহুদী মেনুহিনের সঙ্গে জার্মানির 'বেস্ট চেম্বার মিউজিক পারফরম্যান্স পর ওয়েস্ট মিট ইস্ট' পুরস্কার পেলেন। ১৯৭১ -এ বাংলাদেশ শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য করলেন জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। এ ভাবেই বিশ্বজোড়া এক আশ্চর্য খ্যাতিতে ডুবে গেলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ' রবু' ।
কোনো ঘরানাদার পরিবারে জন্ম হয়নি রবিশঙ্করের। পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য বহন না করেও যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে এতখানি জনপ্রিয় করে তোলা যায় তা সেই সময়ে ভাবনারও বাইরে ছিল। তবে বিতর্ক তাঁকে ছাড়েনি। দুঃখ করে বলেছেন, "It is ironic that in these very same moments I am being criticized in my own country for 'prostituting' my music and commercialized it, for being a big hero only to the hippies, for associating my music with drugs and for encouraging dissatisfied youths from the West to flock of India."
সেতারের কাঠামোয় পরিবর্তন এনেছিলেন রবিশঙ্কর। পরিবেশনেও এনেছিলেন বদল। বিদেশে সঙ্গীত পরিবেশনের ধরণটি যে দেশের মতো হবে না তা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। দ্রুতগতির জীবনধারায় অভ্যস্ত মানুষজনের কাছে সঙ্গীত পরিবেশন করতে চাইলে তার পরিবেশনের ধরণও বদলাতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাচীনত্বের, বিশুদ্ধতার দোহাই চলবে না। কৈশোর থেকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ তাদের মানসিকতা সম্বন্ধে তাঁকে ওয়াকিবহাল করেছিল। প্রাচ্যের গভীরতা আর পাশ্চাত্যের কর্মোন্মাদনা তাঁর মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। লোকসঙ্গীত থেকে গণসঙ্গীত, কাশীতে শোনা স্ত্রোত্রবন্দনা থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীত-শাস্ত্রীয় এবং অন্যান্য- সঙ্গীতের প্রায় সব ধারার সঙ্গে তাঁর যোগ তাঁকে পরিপূর্ণ সঙ্গীতজ্ঞ করে তুলেছিল। যিনি সেতারে সুর তুলেছেন, একাধিক রাগ সৃষ্টি করেছেন, গানবাজনা নিয়ে লিখেছেন, আত্মকাহিনীতে তুলে ধরেছেন গান- বাজনার নানান খুঁটিনাটি, জীবনের গোপন অনেক কথা থেকে তত্ত্বকথা।
দেশে-বিদেশে সর্বত্র খ্যাতির শিখরে উঠেও অপ্রাপ্তির বেদনা ছিল তাঁর। বলেছেন, "মানুষ দেখে বাইরের রবিশঙ্করকে, দুঃখী রবিশঙ্করকে কে চেনে"? সুরের রাজা যিনি তাঁরও দুঃখ! বলেছেন, "আমি নিজের বেদনা সঙ্গীতে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি, কথা দিয়ে মানুষকে শোনাতে চাইনি"। তিনি জানতেন, "দুঃখের শেষ নেই, ভালোবাসার কথা বলি বরং"। তাঁর সঙ্গীতে সেই ভালোবাসার কথাই ধ্বনিত হয়েছে।
১৯৭২ সাল থেকে তাঁর শরীরে নানান সমস্যা দেখা দিল। চিকিৎসা চলছিল, চলছিল বাজানোও। আস্তে আস্তে কমিয়ে এনেছিলেন কাজ। ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় তিনি পাড়ি দিলেন চির সুরের রাজ্যে। তখনও তাঁর মুকুটে ছিল নতুন পালক। দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডের গিনেস রেকর্ড।