জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুরূপ, রথে বুদ্ধদেবের মূর্তি স্থাপন করে রথযাত্রার চল ছিল একসময়

এখন শ্রীক্ষেত্রে তিনটি রথ ব্যবহৃত হলেও আজ থেকে সাতশো বছর আগে রথযাত্রার যাত্রাপথ দুটিভাগে বিভক্ত ছিল। আর সেই দুটি ভাগে তিনটি-তিনটি করে মোট ছটি রথ ব্যবহৃত হত। রথযাত্রার নানা অজানা কথা জানতে ক্লিক করুন ছবির লিঙ্কে 

 

            রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম

            ভক্তেরা লুটায় পথে করিছে প্রণাম

            পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি

            মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসে অন্তর্যামী

            

স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে এই মহাজনসমুদ্র মাঝারে  মূর্তি নিয়ে এই রথযাত্রা, সেই রথারোহীর দেবতাটি কে? বহুকাল থেকে জনপদ বিশেষে, রথারোহী দেবতার ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় বৌদ্ধ সামাজিক উৎসবে রথে করে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে পথ পরিক্রমা করা হত। নটরাজ শিবের মূর্তি নিয়ে কর্ণাটকে রথ ভ্রমণের প্রথা আছে। তবে অবিভক্ত বাংলা জুড়ে যে রথযাত্রার প্রচলন বহুদিন আগে থেকে সেইখানে এই রথারোহী দেবতাটি হলেন জগন্নাথ, সঙ্গে বৈমাত্রেয় ভাইবোন বলরাম ও সুভদ্রা। কিংবদন্তী অনুসারে বহু কথা প্রচলন আছে। 

 

উৎকলখণ্ড' এবং 'দেউল তোলা' নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।

 

প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ।

 

বৌদ্ধযুগেও জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অনুরূপ, রথে বুদ্ধদেবের মূর্তি স্থাপন করে রথযাত্রার প্রচলন ছিল। বিখ্যাত চিন পর্যটক ফা হিয়ান খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকে তৎকালীন মধ্য এশিয়ার খোটান নামক স্থানের যে বুদ্ধ রথযাত্রার বর্ণনা করেছেন তা অনেকাংশে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফা হিয়ানের বিবরণ অনুযায়ী ত্রিশ ফুট উঁচু চার চাকার একটি রথকে বিভিন্ন রত্ন, অলঙ্কার ও বস্ত্রে সুন্দরভাবে সাজানো হত। রথটির চার পাশে থাকত নানা দেবদেবীর মূর্তি। মাঝখানে স্থাপন করা হত বুদ্ধদেবের মূর্তি। এর পর সেই দেশের রাজা তাঁর মুকুট খুলে রেখে খালি পায়ে রথের সামনে এসে নতমস্তকে বুদ্ধদেবের উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর মহাসমারোহে রথযাত্রা শুরু হত।

 পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় আজও আমরা দেখে থাকি যে প্রতি বছর রথযাত্রার উদ্বোধন করেন সেখানকার রাজা।রাজত্ব না থাকলেও বংশ পরম্পরাক্রমে পুরীর রাজপরিবার আজও আছে। ওই রাজপরিবারের নিয়ম অনুসারে যিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন, তিনি অর্থাৎ পুরীর রাজা জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাদেবীর পর পর তিনটি রথের সামনে এসে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের সম্মুখভাগ ঝাঁট দেওয়ার পরই পুরীর রথের রশিতে টান পড়ে। শুরু হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।

উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মতোই ফা হিয়ান বর্ণিত খোটানের বুদ্ধ রথযাত্রার সময়ের হিসাব করলে দেখা যায় যে সেটি পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার মতোই আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত হত। এ ছাড়া ফা হিয়েন ভারতে এসে পাটলিপুত্র নগরীতে কুড়িটি রথের এক বিশাল বুদ্ধ-রথযাত্রা দেখবার কথাও লিপিবদ্ধ করে গেছেন। প্রসঙ্গত, জগন্নাথদেবের রূপকে যেমন বিষ্ণুরই আর একটি রূপ বলে মানা হয় তেমনই বুদ্ধদেবকেও বিষ্ণুর দশ অবতারের নবম অবতার রূপে গণ্য করা হয়।

জগন্নাথ মন্দিরের গায়ে যে দশাবতারের মূর্তি খোদিত আছে সেখানেও নবম অবতাররূপে বুদ্ধদেবের মূর্তি রয়েছে।পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল। তারপর যাত্রা করে সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল। সবশেষে থাকে জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির আবরণের রঙ হলুদ। তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগের রঙ লাল।এই ভাবে রথ তিনটি সমুদ্রোপকূলবর্তী জগন্নাথ মন্দির থেকে প্রায় দু'মাইল দূরে গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সেখানে সাত দিন থাকার পর আবার উল্টোরথ অর্থাৎ জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে আসা।

এখন তিনটি রথ ব্যবহৃত হলেও আজ থেকে সাতশো বছর আগে রথযাত্রার যাত্রাপথ দুটিভাগে বিভক্ত ছিল। আর সেই দুটি ভাগে তিনটি-তিনটি করে মোট ছটি রথ ব্যবহৃত হত। কেননা সে সময় জগন্নাথ মন্দির থেকে গুণ্ডিচা আসার পথটির মাঝখান দিয়ে বয়ে যেত এক প্রশস্ত নালা। নাম ছিল বলাগুণ্ডি নালা। তাই জগন্নাথ মন্দির থেকে তিনটি রথ বলাগুণ্ডি নালার পার পর্যন্ত এলে পরে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি রথ থেকে নামিয়ে নালা পার করে অপর পারে অপেক্ষমাণ অন্য তিনটি রথে বসিয়ে ফের যাত্রা শুরু হত। ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা কেশরী নরসিংহ পুরীর রাজ্যভার গ্রহণের পর তাঁর রাজত্বকালের কোনও এক সময়ে এই বলাগুণ্ডি নালা বুজিয়ে দেন। সেই থেকে পুরীর রথযাত্রায় তিনটি রথ।

শোনা যায় একবার রথযাত্রা উপলক্ষে  উচ্চবর্ণের  হিন্দু নরনারী সহ রাজা প্রতাপরুদ্রর সপরিষদ রথের রশি ধরে টানতে চেষ্টা করলে রথের চাকা নিশ্চল ছিল। তখন মহাপ্রভু বলেছিলেন নিম্নবর্ণের অন্তজ মানুষদের রথের রশি ধরার সুযোগ দাও। সবার শক্তি একত্রিত করলে তবেই রথ তার গতি পাবে। সেই ঘটনা ঘটলে রথ আবার এগিয়ে চললো। তাই রথ ধর্ম বর্ণের ভেদাভেদ ছাড়িয়ে এক বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের প্রতীক। জীবন বোধের চূড়ান্ত পাঠ ঘটে রথযাত্রার আঙিনায়। সামগ্রিক বিচারে দেখলে রথযাত্রা যেন সমগ্র সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক।

     

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে

পশ্চাতে বেঁধেছে যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...