প্রজ্ঞা, মেধা আর অভাবনীয় শিল্পভাবনার এক অদ্ভুত মিশেল হলেন রথীন্দ্রনাথ। রথী ঠাকুরই হয়ত ভারতের প্রথম অনথ্রোপ্রেনর। তাঁর মনের দুটি সত্ত্বা ছিল, একটি বিজ্ঞানীর, আরেকটি শিল্পীর। আবার বিশ্বভারতী পরিচালনার ক্ষেত্রে, তিনিই রবীন্দ্রনাথকে সহায়তা করতেন। বলাইবাহুল্য তিনিই ছিলেন একাধারে রবির রথের সারথি; অন্যদিকে বাবাকে সমস্ত ঝড় থেকে রক্ষা করার চাণক্য ! ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি তার প্রথম উপাচার্য হন। রথীন্দ্রনাথের পরিচয় দিতে বেশ বেগ পেতে হয়, স্থপতি, চিত্রশিল্পী, কারুশিল্পী, উদ্যানবিদ, সাহিত্যিক, সর্বোপরি রবি রথের সারথি। ভারতীয় কৃষি ও শিল্পে তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অবদানের কোন দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত মেলে না। রথীন্দ্রনাথের শিল্পীভাবনার নেপথ্যে ছিল তাঁর বাল্য ও কৈশোরের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক ও কাব্যচর্চা বান্ধব পরিবেশ যা তাঁর মধ্যে এক নান্দনিক শিল্প বোধ তৈরি করেছিল। তিনি স্বয়ং তাঁর স্মৃতিকথায় স্বীকার করেছেন — ‘এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই ভারতের শিল্প ও সাহিত্য তখন নূতন জন্ম পরিগ্রহ করেছে।’ বিশ্বভারতীর পরিচালন সমিতির এক সভায় নিজের কথা বলতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন — ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের, কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের। ’
ছোটবেলা থেকেই রথীর গায়ের রং কিছুটা চাপা। সাত-আট বছর বয়সে একবার শিলাইদহ থেকে রথী ফিরে এলেন রোদে-জলে পুড়ে, যেন আরও বেশি কালো হয়ে। পাশেই গগনেন্দ্রনাথদের বাড়িতে জেঠিমা’কে প্রণাম করতে গেলেন তিনি। উত্তর যা পেলেন কিঞ্চিৎ কটু, “ছিঃ ! রবি তাঁর ছেলেকে একেবারে চাষা বানিয়ে নিয়ে এল।’’কথাটা খুবই খারাপ লেগেছিল রথীর ; এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে , তার পর থেকে ওই বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিলেন তিনি। আর এমনই ইতিহাসের সমাপতন যে, গ্রামবাংলার হিত সাধনের জন্য , সেই ‘চাষা’ হয়ে ওঠার শিক্ষা নিতেই, রথীকে একদিন সত্যি-সত্যি বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ!
১৯০৬ সাল, স্বদেশি আন্দোলনের উন্মাদনা তখন তুঙ্গে। বাংলা নেতৃত্ব দিচ্ছে তদানীন্তন পরাধীন ভারতকে; রবীন্দ্রনাথ তখন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছেন ভারতব্যাপী কেন্দ্রীয় চরিত্র। রথীন্দ্রনাথ আর তাঁর সহপাঠী সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক দলের ছাত্রের সঙ্গে জাপানে পাঠিয়ে দিলেন। কিছু দিন পর দুজনে পৌঁছলেন আমেরিকার আর্বানায়, ইলিনয়ের স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানই কৃষিবিজ্ঞানের পাঠ নিচ্ছিলেন রথী ঠাকুর।
১৯০৭ সালে আমেরিকা থেকে রথী পরীক্ষার জন্য একটি বিশেষ জিনিস পাঠাতে বলে চিঠি লিখলেন রবি ঠাকুরের কাছে, কি সেই জিনিস ? জিনিসটি হল আমাদের দেশের মাটি। তাও যে সে মাটি নয়, একবার ফসল দেওয়া মাটি অর্থাৎ যে মাটি উর্বরা শক্তি হারিয়েছে। চিঠি আরও জানালেন তাঁর গবেষণার কথা, বিদেশে মাটিই বিশ্লেষণ করছেন না, সেই সঙ্গে শস্য এবং পশুখাদ্য নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।
২১শে জুন ১৯০৮ সাল ছেলেকে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে ছেলে এদেশের চাষীদের গতি করতে লিখলেন, পিতা পুত্রের উদ্দেশ্যে একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন কার্যত! এবার দেশে প্রত্যাবর্তনের পালা এই বিখ্যাত চাষার, বাবাকে নিরাশ করলেন না রথী।রবীন্দ্রনাথের ডাকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে ১৯০৯ সালে ফিরেই রথী চলে গেলেন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ যেন এই সময় একেবারে আঁকড়ে, তাঁর অবলম্বনকে। তাঁকে চেনালেন বাংলার পল্লীরূপ, মাঠ নদী ক্ষেত। বাবা ছেলে বন্ধু হয়ে উঠলেন। ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজননশাস্ত্র, অভিব্যক্তিবাদের কথা শুনতেন মুগ্ধ চিত্তে। বাবার স্মৃতি চারণায় তিনি লিখে গিয়েছেন, ১৯১০ সালের ঐ সময়টাতেই তাঁরা বাপ-ছেলে সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলেন।
শিলাইদহেই শুরু হল কর্মযজ্ঞ, রথীন্দ্রনাথ গড়ে তুললেন ক্ষেত! ঐ কৃষিফার্ম বলা যায়। মাটি পরীক্ষার জন্য গবেষণাগার। বিদেশ থেকে আমদানি করলেন ভুট্টার এবং গৃহপালিত পশুর খাওয়ার মতো ঘাসের বীজ। চাষীদের আলো টমেটো চাষ শেখালেন। কৃষির উপযোগী লাঙল, ফলা, আর নানা যন্ত্রপাতি রেডি হয়ে গেল, মন আর চোখটা বিজ্ঞানীর ছিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কাছ থেকে পাতিসরের জন্য চেয়ে আনলেন একটা ট্রাক্টর। যা তিনি স্বয়ং চালাতেন। ইচ্ছে আর সময়ের সমাপতন তাঁকে চাষা বানিয়েই দিল। গোলাপ বাগানও করেছিলেন, আবার সেসব ছেড়ে বাবার ডাকে চলে গিয়েছিলেন লাল মাটির দেশে।
কিন্তু তিনি ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভার সমাহার সন্মিলিত রূপ বলাই শ্রেয়। রবি ঠাকুরের ছেলে যখন লেখার হাত তো ভালো হবেই, আর ঠাকুর বাড়ির সবাই কিছু না কিছু লেখার ছোঁয়া রেখেই গিয়েছেন, ও বাড়ির গুনই বোধকরি এমন। বাবার নির্দেশেই প্রাঞ্জল বাংলায় তিনি অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ অনুবাদ করেন। তাঁর লেখা অন্য দুটি বই অফ, ‘প্রাণতত্ত্ব’, এবং ‘অভিব্যক্তি’, এছাড়াও ইংরেজিতে “On the Edges of Time”। প্রবন্ধও লিখেছেন অজস্র। ক্যামেরা বন্দি করতে ওস্তাদ ছিলেন, ছবি তুলতেন। শুধু লেন্সেই নয় ক্যানভাসেও কেরামতি দেখিয়েছেন রথী ঠাকুর।
চমৎকার ছবি আঁকতে পারতেন। বিভিন্ন ফুলের ছবি আঁকায় তাঁর হাত ছিল যাকে বলে সৌরভের অফ ড্রাইভের মতো স্বর্গীয়! ল্যান্ডস্কেপও আঁকতেন, তবে ফুলের ছবি যেন তাঁর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠত। ফুুল যে শুধু ক্যানভাসে ফুটাতেন তা কিন্তু নয়। বাগানের সখ ছিল। যেখানে যেখানে থেকেছেন বাগানও গড়ে গিয়েছেন। বিদেশী ফুল থেকে শুরু করে দেশী জংলী নাম না জানা ফুল কিছুই বাদ যেত না। শান্তিনিকেতনের উদয়ন থেকে শুরু করে অন্তরালের দেরাদুন সব জায়গাতেই বাগান ছিল কমন। এই বাগানের নেশাতেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। যে শান্তিনিকেতনে গোপাল ফুটতো না, সেখানেও গোলাপ ধরিয়েছিলেন তিনি। গাছের সংকর নিয়ে নানান চর্চা করতেন, উদ্যানপালন বিদ্যা যে তাঁর মজ্জায় মজ্জায়! ফুলের সাথে মৌমাছিরও চাষ করতেন। আদ্যন্ত সৌখিন মানুষ ছিলেন, গোলাপ, জুঁই, মগরাসহ নানা রকম ফুলের আতর আর সুগন্ধি পাউডার জাতীয় প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি করতেন। তাঁর আতরের নাম ছিল আর্টি পারফিউম। শান্তিনিকেতনের অনেক বাড়ির নকশাই তাঁর তৈরি করা। শান্তিনিকেতনের ছোট ছোট ছাত্রাবাস হোক বা সৌখিন উদয়ন, ছায়ানীড় থেকে শুরু করে স্বেচ্ছানির্বাসনের জন্য বানানো রাজপুরের ‘মিতালি’ সবেতে স্থপতি রথী ঠাকুর ধরা দেন।
রান্নায় ছিলেন পটু, রান্নার গুনটি ঠাকুর বাড়ির ডিএনএ-তেই ছিল বোধহয়। জ্যাম-জেলি বানানো, কখনও কখনও অতিথি সেবার জন্য খুন্তিও ধরতেন। আচার আর দই পাতায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। গান গাইতেন, যন্ত্রসঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন, দারুন এস্রাজ বাজাতেন।
চামড়ার উপর নকশা করায় ছিলেন পারদর্শী। এদেশে চামড়ার উপর কাজের শিল্পকলার কান্ডারী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। তিনি জনক। ১৯২৪-এর ইউরোপ যাত্রাই রথীন্দ্রনাথ নাথকে চামড়ার কাজের প্রতি আকর্ষিত করেছিল। রানী চন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায়, উত্তরায়ণের জাপানিঘর সংলগ্ন দক্ষিণের বারান্দায় সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে চামড়ার কাজে লেগে পড়তেন রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী। চামড়ার ওপর নকশা করে নিজেদের সৃজনশীলতার সাহায্যে, চর্মশিল্পের একটি ভারতীয় সংস্করণ তৈরি করলেন। শান্তিনিকেতনী চর্মশিল্প- এক স্বতন্ত্র রীতি তৈরি হল, এই শান্তিনিকেতনী রীতির জনক হলেন রথী ঠাকুর। আজ শান্তিনিকেতনের লেদার ব্যাগের কত সুনাম। শান্তিনিকেতন এর ভৌগোলিক সত্ত্বও পেয়েছেন।
চর্মশিল্প আর বাটিক শিল্প এই দুয়ের প্রবর্তক হিসেবে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাবেন, শান্তিনিকেতনে এসবের আমদানী তাঁর হাত ধরেই।
এক অসাধারণ দারুশিল্পী ছিলেন তিনি। কাঠ খোদাই করে কত অসামান্য শিল্প সৃষ্টি করেছেন। জ্যামিতিক চিত্র, ভারতীয় শিল্পশৈলীর মাধ্যমে আসবাবের অভিনব সব নকশা তৈরি করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ হল তাঁর শিল্পী মন, তাই সব কিছুতেই নিজস্বতা বিদ্যমান। হয়ত তিনি নিজেই এই স্বকীয়তা তৈরি করতেন। কাঠের কাজ করতে খুবই ভালো বাসতেন, নিজের হাতেই করতেন কাঠের যাবতীয় কাজ। আজ যে এদেশে স্থানসংকোচনশীল আসবাবপত্র পাওয়া যায় তারও পথিকৃৎ রথীন্দ্রনাথ।
বিশ শতকের শুরুতে গ্রামের শিল্পী সমাজ ভেঙে পড়েছিল, রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ছিল এদেশে শিল্পীকে মজুরে পরিণত করা হচ্ছে।
শিল্পীকে মজবুর মজদুর হওয়া থেকে রুখতে তাদের স্বনির্ভর করতে হবে। বাবার ইচ্ছেকে বাস্তব করার কাজেই ব্রতী হয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। পরাধীন ভারতেও এও তো এক স্বাধীনতার লড়াই। প্রতিমাদেবীর উদ্যোগে ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের কলাভবন চত্ত্বরে কারুশিল্পকে কেন্দ্র করে বিরাট যজ্ঞ শুরু হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ১৯২৮ সালে এই চর্চাকে সরিয়ে নিয়ে যান শ্রীনিকেতন রেল কোম্পানীর এক পরিত্যক্ত ঘরে, নাম দেন হল অফ ইন্ডাস্ট্রি। গ্রামীণ শিল্পবিভাগটির দায়িত্ব বর্তায় সেই নির্ভরযোগ্য কাঁধে দীর্ঘদিন ঐ দায়িত্ব তিনি সামলেছেন। মানুষ স্বনির্ভর হয়েছেন, জীবন জীবিকা সুনিশ্চিত হয়েছে, শিল্প বিভাগটি সার্থক বাণিজ্য-বিপননের আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে। আজ শান্তিনিকেতনের শিল্প সামগ্রী বাংলার ঐতিহ্যের সমার্থক হয়ে গিয়েছে, সারা বিশ্বে দাপিয়ে ছুটছে বাংলার নিজস্ব জিনিস যার নেপথ্যে রয়েগিয়েছেন এক বৈজ্ঞানিক শিল্প মনের অধিকারী এক অতিমানবিয় প্রতিভা। সার্থক হয়েছে রথী ঠাকুরের পরিশ্রম।