তাঁর জীবন অবলম্বনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় "সব্যসাচী" উপন্যাসটি লিখেছিলেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু সহ আরো বহু তরুণ বিপ্লবী।
এই মানুষটি স্বাধীনতা আন্দোলনের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছিলেন। মনে করা হয়, তাঁর সহযোগী বিপ্লবী বাঘাযতীনের যদি ১৯১৫ সালে মৃত্যু না হতো তাহলে তিনি, বাঘাযতীন এবং তাঁদের সহযোদ্ধারা মিলে আরো অন্ততঃ তিরিশ বছর আগে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশ মায়ের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করতে পারতেন।
১৮৮৬ সালের ২৫ মে বর্ধমান জেলার সুবলদহ-তে জন্ম তাঁর।
স্কুল জীবন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঝুঁকেছিলেন তিনি। দাদু কালিচরণ বসু এবং তার শিক্ষকদের থেকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প শুনে তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
শোনা যায়, তিনি ইংরেজদের মূর্তি তৈরি করে লাঠি খেলার কৌশলে সেই মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেলতেন।
একটু বড় হয়েই জড়িয়ে পড়লেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে। সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দিল্লি ষড়যন্ত্র, বেনারস ষড়যন্ত্র এবং লাহোরের গদর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
শুরুর দিকেই তিনি নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং আলিপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর লর্ড হার্ডিঞ্জয়ের উপর যে হামলা হয় তার মাস্টারমাইন্ডও তিনিই।
১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যা করতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ভাইসরয় অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও এই ষড়যন্ত্রের মূল নায়কদের খোঁজে সারা দেশে তল্লাশি শুরু করে ব্রিটিশ পুলিশ। গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজলেও ধরতে পারেনি তাঁকে। পুলিশের খাতায় তিনি ছিলেন ‘বিপজ্জনক’ বিপ্লবী। ছদ্মবেশ ধারণেও ছিলেন দুর্ধর্ষ।
সেই সময় বিদেশ যাত্রায় যাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে, ছদ্মবেশে ‘প্রিয়নাথ ঠাকুর’ নাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় সেজে ১৯২৩ সালে দেশ ছাড়েন সেই মহান মানুষটি। পৌঁছান জাপান। দেশের স্বাধীনতা আনার জন্য জাপানে লুকিয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। ভারত ছেড়ে যখন জাপানে চলে যান, সেই সময়ে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল সেখানকার একটি পরিবার... সোমা পরিবার।
বিবাহ করেছিলেন সেই সোমা পরিবারের মেয়ে তোশিকো সোমাকে। তাঁদের একমাত্র পুত্রও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করেছিলেন।
ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে। পরবর্তী সময়ে এটিই হয়ে ওঠে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজ। জাপানে বসবাস করেও এক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হননি নিজের দেশের মানুষের দুঃখের কথা। ভারতের পরাধীনতার লাঞ্ছনাকে ভোলেননি তিনি কোনোদিন। নিজের কাজের দায়িত্ব সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তিনি... ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিযুগের মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু।
জাপান সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান অর্ডার অফ দ্য রাইজিং সান-এর খেতাবে ভূষিত করেছিল। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর স্বপ্ন ছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের মুক্তি। শতকোটি প্রণাম জানাই এই মহান বিপ্লবীর চরণকমলে।