রাধার জন্ম হয়েছে মাত্র এগারশো বছর আগে। মহারাষ্ট্রের কবি হাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে যখন ‘গাহাসপ্তসতী’ নামের একখানা কাব্য রচনা করে ফেললেন, তখন সবাই জানলেন যে, কৃষ্ণের একজন রাধা নামের প্রেমিকাও আছে, যাঁকে না-হলে কৃষ্ণের লীলা সম্পূর্ণ হয় না। ফলে, রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহের পূজাই বলুন, উপাসনাই বলুন আর রাধাভাবের ভজনতত্ত্বই বলুন সবই উদ্ভূত হয়েছে এই সপ্তম শতক এবং তার পরবর্তী সময়ে। সুতরাং, কৃষ্ণের রাধা ও গোপীকাদের নিয়ে বছরে তিনটি পূর্ণিমায় যে আনন্দলীলা করেন-বর্ষায় 'ঝুলন', হেমন্তে 'রাস' আর বসন্তে 'দোল'-তারও উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এই সপ্তম শতক ও তার পরবর্তী সময়ে। কারণ, চার বেদ, উপনিষদ এবং প্রাচীন পুরাণসমূহে কোথাও রাধার উল্লেখ নেই। এমনকি মহাভারতের অন্তর্গত হরিবংশেও কৃষ্ণের পরকীয়া-প্রেমিকা রাধার নামই উচ্চারিত হয়নি। এখন কবি হাল হঠাৎ করে সপ্তম শতকে এসে রাধাকে কোত্থেকে পেলেন তার উত্তর কোথাও পাওয়া যায়নি। তিনি নিজের কবিকল্পনায় সৃষ্টি করেছেন, নাকি লোকগাথার মধ্যে পেয়েছেন-সেটা অনুমান সাপেক্ষ। তবে, হাল রাধাকে যেখান থেকেই পেয়ে থাকুন না কেন, কৃষ্ণের সঙ্গে জুড়ে রাধা কিন্তু সারা দেশের কাছে প্রেমের বিশিষ্ট প্রতীক হয়ে উঠেছেন ধীরে ধীরে। ভাবুক ভক্তের অন্তর হয়ে গেছে রাধা। কৃষ্ণকে পাবার জন্য, তাঁর সঙ্গ পাবার জন্য ভক্তের বাসনা রাধা হয়ে ধরা দিয়েছে যুগল মূর্তিতে।
এবার আসি রাসের কথায়। ‘রাস’ কথাটার অর্থই হচ্ছে ‘আনন্দ’। সেই আনন্দ কেমন হবে? সেটা ‘রাসপঞ্চাধ্যায়’ নামের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং সপ্তম শতক-পরবর্তী নানান ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ আছে। এখানে যে গল্প, তাতে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণ কার্তিকের পূর্ণিমায় আয়োজন করেছেন এক আনন্দলীলার, সেই লীলার নাম, 'রাসলীলা'। তার জন্য নির্মিত হয়েছে মণ্ডপ। সেখানেও ঝুলনলীলার মতো রাধার আসতে বিলম্ব হল, একপ্রস্থ মান-অভিমানের পালা চলল কৃষ্ণের সঙ্গে। তারপর মান ভাঙিয়ে রাধা ও সমস্ত গোপীকাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চক্রাকার সেই মণ্ডপে বৃত্ত রচনা করে নাচ ও গানে মেতে উঠলেন কৃষ্ণ। এই সময় এক কৃষ্ণ বহু হয়ে উঠলেন এবং এই বৃত্তের প্রতিটি গোপীকার পাশে তিনি অবস্থান করলেন, প্রত্যেকের হাতে রাখলেন তাঁর হাত। এর আধ্যাত্মিক ভাষ্য হচ্ছে, যেমন করে রাধা ও গোপীকা আকুতি নিয়ে (একবার দেবী অম্বিকাকে অনেক অর্চনার মধ্য দিয়ে তুষ্ট করে গোপীকারা তাঁর কাছে কৃষ্ণকে স্বামীর মতো একান্ত করে পাওয়ার বাসনা জানিয়ে বর লাভ করেছিলেন) কৃষ্ণকে ভজনা করে সকলেই সমানভাবে এই লীলায় একান্ত করে পাচ্ছেন; তেমনি ভক্তকূলও যদি সেই রাধা ও গোপীকাদের মতো আকুলতা নিয়ে কৃষ্ণকে কামনা করেন, তাহলে কৃষ্ণও তাদের কৃপা করে আপন করবেন। এভাবে কৃষ্ণকে একবার পেলেই তাঁদের কাছে জগত হয়ে উঠবে রাসলীলার মতোই আনন্দময়। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই রাধাভাব বা গোপীভাবে বৈষ্ণবের কৃষ্ণভজনার সূচনা।
আধ্যাত্মিকতার বাইরে এবার আসুন একটু অন্যভাবে দেখি এই রাস উৎসবকে, লোকসংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে। আসলে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ তো কৃষির দেশ। তাই এখানকার যে-কোন উৎসবের মূল খুঁজলেই পাওয়া যাবে কৃষির উদ্যোগ ও অবসরের মাঝে জাদুভিত্তিক আচার। কোথাও বা বিনোদন। রাসের এই যে চক্রাকারে নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে নারীপুরুষের আবর্তন, তা যেমন একদিকে নিরন্তর বা অখণ্ড আনন্দপ্রবাহের ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে আবার প্রাণীকুলের অখণ্ড জীবনচক্র ও ঋতুভিত্তিক কৃষির উৎপাদনচক্রের ইঙ্গিতও দেয়। নারীপুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্মিলন তো নতুন অপত্য সৃষ্টির কথাই বলে। বর্ষায় ফসল বোনার সময়ে ঝুলনে এই সম্মিলন, শীতের ফসল বোনার আগে রাসে এই সম্মিলন কিম্বা গ্রীষ্মকালীন ফসল বোনার আগে দোলে এই সম্মিলন নতুন ফসলের আহ্বানকেই প্রতীকায়িত করে। তাই অনুমান করা যায়, আমাদের আবহমান সংস্কৃতি-ধারার কোন এক বাঁকে প্রাচীন কৃষিকামনামূলক জাদু-আচার ও ধর্মভাবনা মিলে গিয়ে মিশে গিয়েই হয়তো একদিন গড়ে উঠেছিল আজকের 'রাসলীলা' তথা 'রাস উৎসব'।