প্রায় ১২৫ বছরের পুরনো মধ্য হাওড়ার প্রিয়নাথ ঘোষের রাস যাত্রা। হাওড়া স্টেশন থেকে রামরাজাতলাগামী রাস্তার মাঝে ঘোষপাড়া। প্রিয়নাথ ঘোষের নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম ঘোষপাড়া। প্রতিবছর ঘোষবাড়িতে রাসযাত্রা এবং তাকে ঘিরে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ছোট ছোট পুতুল, দশাবতার দিয়ে সাজানো হয় রাস। তবে এই রাস উৎসবের মূল আকর্ষণ পুতুলনাচ। সেই টানেই প্রতিবছর দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ। একশো বছরেরও বেশি পুরনো এই রাসযাত্রা ঘোষ পরিবার আজও ঐতিহ্য মেনে করে থাকেন।
জনশ্রুতি আছে হুগলি জেলা থেকে জীবিকার সন্ধানে হাওড়ার এই অঞ্চলে এসেছিলেন প্রিয়নাথ ঘোষ। ইমারতী ছিল মূল ব্যবসা। তিনি ছিলেন আদ্যন্ত উদ্যোগী পুরুষ। পাশাপাশি হাত দেন আরও নানারকম ব্যবসাতে। হাওড়ায় চুনের ব্যবসা তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন।
বাঁধা ঘাটে গড়ে ওঠে তাঁর চুনের কারখানা। ব্যবসা প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাড়ি তৈরি করেন। ১৮৯৭ সাল নাগাদ বাড়িতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠার পরপরই রাসযাত্রার আয়োজন করা হয়। শুধু রাস নয়, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী ঘোষ পরিবারে জাঁক জমকের সঙ্গে পালন করা হয় এবং তা এই অঞ্চলে যথেষ্ট প্রসিদ্ধ।
রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষ্ণের মূর্তিটি কষ্টি পাথর এবং রাধিকার মূর্তিটি ধাতুর তৈরি। ১৯২৪ সাল নাগাদ কৃষ্ণের অঙ্গহানি ঘটে। বাম পা ভেঙে যায়। পরে আবার পুনরায় মূর্তি নির্মাণ করা হয়। রথযাত্রার সময় এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। এই ঘটনার পরে রথের উচ্চতা কমানো হয়। নতুন রথটি তৈরি করেন ওয়েলিংটনের এক মুসলিম কারিগর।
ঘোষ পরিবার অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত রকম আচার-অনুষ্ঠান মেনে রাসযাত্রা করে থাকেন। রাধা-কৃষ্ণ এই পরিবারের কাছে শুধু কূল দেবতা নয়, তিনি পরিবারের একজন সদস্য। পরিবারের কোন সদস্যের কাছে তিনি যদি হন দাদা-বৌদি তাহলে অন্য কোন সদস্যের কাছে তিনিই আবার ঠাকুর্দা-ঠাকুমা। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রিয়নাথ ঘোষ প্রায় ৯৯ বছর বেঁচে ছিলেন। ১৯৩৬ সালে তিনি মারা যান। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সবাই প্রায় দীর্ঘায়ু। এই পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস তাঁরা অতি নিষ্ঠাভরে রাসযাত্রা বা দেবতার সেবা করেন বলে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সবাই দীর্ঘায়ু।
কলকাতা পোর্টের কাছে "সোনাই" নামের একটি জায়গা প্রিয়নাথ ঘোষের অধীন ছিল। এই জমি ব্রিটিশ সরকার পোর্ট তৈরি করার সময় তিন লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে নেয়। জমি বিক্রির টাকা এবং বিভিন্ন বাড়ি ভাড়া বাবদ যে টাকা আসত তা দেবত্র নামে লিখে দিয়ে যান। দেবতার সেবায় সেখান থেকেই অর্থ ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে সেই খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও মিলিতভাবে রাসযাত্রার অনুষ্ঠান করে থাকেন।
নীলমণি গোস্বামী হলেন ঘোষ পরিবারে কুলপুরোহিত। সেই সঙ্গে এই পরিবারের গুরুদেবও। তিনি নদিয়া নিবাসী। রাসযাত্রা, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী তাঁর পৌরহিত্যে এতদিন হয়ে এসেছে। তিনবছর আগে তাঁর দেহাবসান হয়েছে। বর্তমানে নতুন পুরোহিত দেবতার সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন।
রাসের দিন সকাল ৫-৫:৩০ মিনিটে মঙ্গলারতির মাধ্যমে রাধা-কৃষ্ণকে ঘুম থেকে তোলা হয়। তারপর স্নান করানো হয়। সকালে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় মিছরি আর মাখন। দুপুরে থাকে অন্নভোগ। রাসযাত্রার পনেরো দিন আগে আয়োজন করা হয় অন্নকূটের। রাধা-কৃষ্ণ ও নারায়ণসহ চারটি থালায় ভোগ নিবেদন করা হয়। শাক, ভাত সহ বিভিন্ন রকমের নিরামিষ পদ অন্নভোগে পরিবেশন করা হয়। অন্নভোগের পর মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বিকেলে ৫-৫:৩০ নাগাদ রাসমঞ্চে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করার পর ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় লুচি আর চিনি। সন্ধ্যেবেলায় ভোগ হিসেবে থাকে লুচি, বাতাসা, সন্দেশ আর দুধ। সন্ধ্যারতির পর রাত ১০টা নাগাদ শয়ান দেওয়া হয়।
রাস্তা থেকে শুরু করে নাটমন্দিরের সামনে মাটির পুতুল দিয়ে সাজানো হয়। আর থাকে দশাবতার। অতীতে শিল্পীর করা পৌরাণিক কাহিনি বা বিখ্যাত মণীষীদের জীবনীর ওয়েল পেন্টিং টানানো হত। বর্তমানে সেটি বন্ধ। রাসযাত্রার জন্মলগ্ন থেকে চলে আসছে পুতুল নাচ যা আজও বর্তমান। মাঝে এক-দুবার দল বদল হলেও পুরনো দলই এখনও পুতুল নাচ প্রদর্শন করে চলেছে।
বর্তমানে প্রিয়বাবুর রাসযাত্রায় আগের থেকে জাঁকজমকে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। অতীতে নহবত বসত। এখন আর বসে না। গতবছর ভেঙে ফেলা হয় নহবতখানা। এই বছর করোনার জন্য রাসযাত্রা কোনরকমে করা হচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে শুধুমাত্র পুজো হবে। বাইরের লোকজনের অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়েছে। মেলা বা রাসের মুখ্য আকর্ষণ পুতুলনাচ থাকবে না। যা এর আগে কখনও হয়নি।