ইতিহাসের স্বাক্ষী এই রঞ্জন প্যালেস

আজকের  রঞ্জন প্যালেস  বহু  ইতিহাসের  সাক্ষ্য    বহন করে দাঁড়িয়ে আছে হেতমপুরে। আজকের হেতমপুর যে নামে  পরিচিত সেটা পোশাকি । এর পূর্ব নাম ছিল রাঘবপুর, এই নামের পরিবর্তনের পিছনে  একটা ইতিহাস আছে। রাজনগরের জমিদার রাঘব রায়ের নামে নামকরণ হয়েছিল স্থানটির। রাজনগর রাজাদের অনুরোধে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান এসেছিলেন, বিদ্রোহী রাঘব রায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। রাঘব রায় পরাজিত হয়ে  পালিয়ে গেলে, হাতেম খান এই জায়গার জমিদার হয়ে ওঠেন এবং এর নামকরণ করা হয় হাতপুর। সময়ের সাথে সাথে উচ্চারণ দোষে দুষ্ট হয়ে এটি হয়ে উঠেছে হেতমপুর।  যদিও এ ঘটনা বঙ্গে নতুন নয়। এবার জানবো সেই রাজপরিবার ও তার ইতিহাসসমৃদ্ধ রাজবাড়ি সম্পর্কে। 

 

                                      হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে  চাকরিতে যোগ দেন।  তাঁর মৃত্যুর পর  বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ  মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান  হেতমপুরের জাঁদরেল রায়বংশের জমিদারিতে নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে তিনি একটা সময়ে সেরেস্তার দায়িত্ব পান। আর্থিকভাবেও ধনী হয়ে জমিদারির ইজারা কিনে সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন। একটা সময়ে তাঁর প্রতিপত্তি রায়দেরও ছাড়িয়ে যায়  এমনকি মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকে তিনি কিছু মহল আর জমিদারি কেনেন। এই রাধানাথ চক্রবর্তী ছিলেন হেতমপুর রাজ পরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা  তিনি বীরভূম রাজের ১৯ টি মৌজার ইজারা নিয়ে ক্রমে  মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত করেন। এই সময় তিনি রাজনগরের সাথে এক যুদ্ধ জয়ী হয়ে  বীরভূম এবং আশেপাশের অঞ্চলের স্বাধীন বাঙালি রাজা হন শেষ পর্যন্ত তিনি রায় পরিবারকে তারই  বেতনভুক্ত করে তোলেন ১৮৩৮ সালে তাঁর  মৃত্যুর  সময় তাঁর সম্পত্তিগত  আয় ছিল ২০,০০০০ রুপি।  ব্রিটিশ শাসকদের বশ্যতা স্বীকার  করায় তিনি  মহারাজা উপাধি পান।

                             রাধানাথ মারা গেলে তাঁর বড়ো ছেলে বিপ্রচরণ জমিদারিকে আরো বিত্তশালী ও সমৃদ্ধশালী করে তোলেন। রাজা বিপ্রচরন ছিলেন সর্বাধিক সফল শাসক বাবার মৃত্যুর সাত বছরের মধ্যেই তিনি তাঁর রাজ্যকে বীরভূমের বৃহত্তম স্থানে পরিণত করেন। তিনি  রাজনগর রাজ পরিবারের বিবি রাজীবুন্নিসা কে ৫০,০০০ ঋণের বিনিময়ে লাভ করে আরও জমি করায়ত্ত করেন। সাঁওতাল পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলিও তার শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। জানা যায় বিপ্রচরণ সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে বেশ অবদান রেখেছিলেন। তার ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি মেতে থাকতেন। তাঁর ছেলে রামরঞ্জন বানিয়েছিলেন হেতমপুরের সেই বিশাল প্রাসাদ  

                                  ১৮৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এই রামরঞ্জন চক্রবর্তী ব্রিটিশ সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন যার ফলে ১৮৮৫ সালে  ব্রিটিশ সরকার   খুশি হয়ে  তাঁকে  ‘রাজাউপাধিতে  ভূষিত করেন।  দুই বছর পরে তাঁকে লর্ড লিটন  রাজা বাহাদুরের পদে উন্নীত করেন। ১৯১২ সালে তিনি মহারাজার পদে উন্নীত হন।

                        

                                 ১৯০৫ সালে রামরঞ্জন চক্রবর্তী রাজবাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। তাই এই বাড়িটাকে রঞ্জন প্যালেস নামেও ডাকা হয়। ইংরেজ সরকারের সঙ্গে এই রাজপরিবারের সখ্যতা অবশ্য বেশ  পুরোনো। জানা যায় কাজী নজরুল ইসলাম বেশ বহুদিন এই প্রাসাদেই আত্মগোপন করেছিলেন। যদিও কিছুদিন বাদে গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

      

                                দুর্গের মতো দেখতে এই বিশাল প্রাসাদের  দরজার সংখ্যা ৯৯৯টি। মুর্শিদাবাদের নবাব হুমায়ুন জা- তৈরি করা হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সম্মান যাতে  অক্ষুন্ন থাকে, তার জন্য হাজারদুয়ারির থেকে একটা দরজা কম রাখা হয়েছিল এই বাড়িতে। তবে স্থানীয় লোকজনের মুখে এই প্রাসাদের নাম হয়েছিল হেতমপুরের হাজারদুয়ারি হেতমপুরের রাজ পরিবারের আবাস এই অট্টালিকা।

                                  সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে রাজবাড়ির সেট ছিল হেতমপুর প্রাসাদে। আরও অনেক বিখ্যাত ছবির শুটিং এখানে হয়েছে। সত্যজিতেরইঅভিযান’, মৃণাল সেনেরমৃগয়া’, তরুণ মজুমদারেরগণদেবতা’, সন্দীপ রায়েরগোঁসাইপুর সরগরম’, রাজা সেনেরদামু’- কথা তো বলতেই হয়। হেতমপুর রাজ পরিবারের বিপ্রচরন চক্রবর্তী হেতমপুরে সরস্বতী পূজা শুরু করেছিলেন। তাঁর নাতি রামরঞ্জন এ উপলক্ষে ৩ দিনের মেলা শুরু করেন । গুরুসদয় দত্ত  একবার মেলা চলাকালীন রায়বেশ ব্রতচারি  উপস্থাপন করেছিলেন। অনেক নামী ব্যক্তিত্ব সেই মেলায় অংশ নেন। মেলায় হেতমপুর রয়্যাল থিয়েটার এবং রঞ্জন অপেরা তাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করেন  ।

                           হেতমপুর রাজবাড়ির রথটাও খুব বিখ্যাত। এখন হেতমপুর বীরভূম জেলায় সিউড়ি সদর মহকুমার একটা শহর আর হেতমপুর রাজবাড়ির একাংশে এখন রয়েছে ডিএভি পাবলিক স্কুল, আর আছে বিএড কলেজ। সদস্যরা আজও  আছেন, চাইলে সেখানে ঘুরে আসতেই পারেন, আতিথেয়তার অভাব হবে না।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...