লোকমাতা রানি রাসমণি

হালিশহর এবং কাঁচড়াপাড়ার মাঝে রয়েছে বাগমোড়, সেখানে পৌঁছলে থমকে দাঁড়াতে হয় এক মূর্তির সামনে। দাঁড়িয়ে রয়েছে এক নারী মূর্তি। এক সাধারণ কৃষিজীবি পরিবারের এক অসাধারণ মেয়ের মূর্তি, আঠারো-উনিশ শতকের নারীশক্তির মূর্ত প্রতীক এই মূর্তি। এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে থেকে জানবাজারের রানিমা। একটি উত্তরণের কাহিনী। এক কৈবর্ত্য মহিলার লোকমাতা হয়ে ওঠার কাহিনী রয়েছে তাঁর গোটা জীবন জুড়ে।

শুধু পরাক্রমে নয়, ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন লোকমাতা। প্রজাপালন আর শত্রুর দমন, দুটি কাজেই সমান পারদর্শী। এক যোগ্য শাসকের ভূমিকায় তাঁর উত্তরণ হয়েছিল স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর।

কুসংস্কার ভেঙেছেন, সমাজ সংস্কার করেছেন, আবার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধরেছেন, হয়ে উঠেছেন লোকমাতা। অদম্য সাহসের অধিকারিণী ছিলেন রানি রাসমণি। তাঁর সাহসিকতার পরিচয় ইতিহাস বারবার পেয়েছে; জনশ্রুতি রয়েছে, কোনও এক কালে রাজচন্দ্র দাসদের জানবাজারের বাড়ির কাছে ইংরেজ সৈনিকদের একটি ব্যারাক ছিল। মদ্যপ সৈনিকেরা একদিন রানির দ্বাররক্ষকদের সরিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে লুটপাট করতে আরম্ভ করে। বাড়ির পুরুষেরা তখন বাড়ির বাইরে ছিলেন।

ইংরেজ সৈনিকেরা কোনোরকম বাধা না পেয়ে ক্রমশ বাড়ির ভিতরে ঢুকে আসছিল, রানিমা নিজে অস্ত্র ধরলেন। এই অজেয় সাহসই ছিল তাঁর সারা জীবনের সঙ্গী। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই তাঁর জীবনে ফিরে ফিরে এসেছে। কলকাতায় তখন জলাশয়ের বাড়বাড়ন্ত, গঙ্গা তো আছেই। কলকাতাবাসীদের মধ্যে বিশাল একটা অংশের জীবিকা ছিল মাছ ধরা।

ওদিকে ব্রিটিশরাজ, গঙ্গায় মাছ ধরার জন্যে জেলেদের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দিল ইংরেজ সরকার। কর না দিলে পেয়াদা পাঠিয়ে অত্যাচার চলত, এমন কি তাদের জালও ছিঁড়ে দেওয়া হত। এই জেলেরা ছিল জানবাজার এলাকার বাসিন্দা, করের বোঝা বইতে না পেরে তারা চলে আসে রানিমার কাছে। সব শুনে, রানিমা বরাভয় দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন তাদের। এরপর বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে, গঙ্গায় মাছ ধরার ইজারা নিয়ে আসেন রানিমা। রানিমা মাছের ব্যবসা করবেন ভেবে সরকার সানন্দে তা দিয়ে দেয়। এবার পাল্টা বদলার পালা।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে জেতা অসম্ভব, তাই কৌশলের পথ ধরলেন রানিমা। রানিমা কোম্পানির কাছ থেকে গঙ্গা থেকে ঘুসুড়ি হয়ে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকা ১০ হাজার টাকার বদলে ইজারা নিলেন। ইজারার দলিল-কাগজপত্র রানিমার হাতে এসে পৌঁছনো মাত্রই জেলেদের হুকুম দিলেন।

রাতারাতি লোহার মোটা মোটা শিকল দিয়ে আটকে ফেলা হল গঙ্গা। ফলে গোটা এলাকার সব ধরনের নৌ চলাচল স্তব্ধ! কোম্পানির বড় বড় পণ্যবাহী বাণিজ্য জাহাজগুলো আটকে গেল।

কলকাতার এক বিধবা মহিলা চোখে চোখ রেখে লড়াই করলেন ব্রিটিশদের সঙ্গে! এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেল। কলকাতায় এমনটা কখনও হয়নি। ক্ষিপ্ত জেলেরা আবার সেই লোহার শিকলের সাথে নিজেদের দড়িও জুড়ে দিয়েছিল। যথারীতি হজম হয়নি ইংরেজদের, রানিমাকে আদালতে তলব করা হল। লোহার শিকল অবিলম্বে খুলে দেওয়ার আদেশ এল। রানি তা করলেন না! কারণ হিসেবে বললেন, তিনি ব্রিটিশদের থেকে ঐ এলাকাটুকু ইজারা নিয়েছেন নিজের ব্যবসায়িক ও প্রজা স্বার্থে।

তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন। তাছাড়া কোম্পানির জাহাজ চলাচলের কারণে জেলেদের জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছেরা এই এলাকায় আসে না। ফলে প্রজার এবং রানীর ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। এও বললেন, এই শিকল তিনি তখনই খুলবেন, যখন তার প্রজাদের ওপর আর করের বোঝা চাপানো হবে না।

রানির বুদ্ধি এবং যুক্তির জোরে কোম্পানি ল্যাজে গোবরে। পরাজয় স্বীকার করে, জেলেদের উপর সকল প্রকার কর উঠিয়ে নেওয়া হল এবং রানিকে ইজারা বাবদ নেওয়া টাকাও ফেরত দেওয়া হল। উত্তর কলকাতার নিমতলা ঘাটের আদি ভূতনাথ মন্দিরের কাছাকাছি এখনও সেই বিশাল লোহার পিলার ও কিছু লোহার শিকল দেখা যায়, যা আজও রানি এই বলিষ্ঠ পদপক্ষেপের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এই ভাবেই দুষ্টের দমন করে শিষ্টের পালন করতেন রানিমা। একবার নয়, বারবার ব্রিটিশের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেঁধেছে। তিনি প্রতিবারই লড়ে জিতেছেন।

একবার জানবাজারের বাড়িতে দুর্গা পুজোর সময় ঢাকঢোল বাজিয়ে, কীর্তন গেয়ে রানির বাড়ি থেকে গঙ্গা পর্যন্ত কলাবৌ স্নান করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোম্পানির সৈন্যরা বাধা দিয়ে বসল। কারণ ঢাক ও কীর্তনের আওয়াজে বাবুদের শান্তি নষ্ট হচ্ছিল। এ খবর পৌঁছল রানিমার কানে প্রতিবাদ হিসেবে রানি তাঁর পুরোহিতদের আরও বড়সড় আয়োজনে মিছিল বের করার নির্দেশ দিলেন।

কোম্পানির বাবুরা রানির বাড়িতে নোটিশ নিয়ে এলে, রানি তাদের চোখের সামনেই সেই নোটিশ ছিঁড়ে ফেলেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অবমাননা করার জন্য রানিকে ৫০ টাকা জরিমানা করা হল এবং রানি তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিলেন। কিন্তু ঝামেলা শেষ হয়নি, কারণ তিনি ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন। এবারও অভিনব এক পন্থা অবলম্বন করলেন রানিমা। তাঁদের বাড়ি থেকে নিউমার্কেট হয়ে বাবু বাজার পর্যন্ত সবগুলো রাস্তা কাঠের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দিলেন। শহরের উত্তর এবং দক্ষিণের মধ্যে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রাস্তাই ওই এলাকার মধ্যে পড়ে গেল।

ফলে শহরের যান চলাচল থমকে দাঁড়াল। যথারীতি এবারও কোম্পানি মামলা ঠুকে দিল। রানি আদালতে বললেন, জানবাজার রাজবাড়ি থেকে নিউমার্কেট হয়ে বাবুঘাট পর্যন্ত এলাকা তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি। নিজের এলাকার মধ্যেই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করেছেন তিনি। বরং সরকারই তাঁকে বাধা দিয়েছে, সরকার দোষী। কারণ সরকার তাঁর এবং প্রজাদের নাগরিক অধিকার হস্তক্ষেপ করেছে আবার জরিমানাও নিয়েছে। এবারও রানির বুদ্ধিমত্তা এবং যুক্তির কাছে হার মানল ইংরেজরা। আদালত কোম্পানিকে সেই জরিমানার অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য করে এবং রানিকে তার ধর্মীয় আচার পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করে।

এই 'যুদ্ধং দেহি' রানিমার একটি নরম রূপও ছিল।১৮৫১ সালের কথা। তীর্থযাত্রা শেষে রানিমা ত্রিবেণী, নবদ্বীপ হয়ে গঙ্গাসাগর যাচ্ছিলেন। চন্দননগরের কাছাকাছি রানির বজরায় ডাকাত পড়ল। রানির দেহরক্ষীদের সাথে গুলি বিনিময় চলল। গোলাগুলিতে ডাকাতদলের একজন আহত হলে, রানি তৎক্ষণাৎ গোলাগুলি বন্ধ করতে বললেন এবং তারা কী চায় তা জানতে চাইলেন। ডাকাত দলের সর্দার ১২ হাজার টাকা দাবী করে বসল, রানি তাতেই রাজী। টাকা দেবেন প্রতিশ্রুতি দিলেন। বিনিময়ে পথে ছেড়ে দিতে বলেন এবং পরের দিন লোক দিয়ে প্রতিশ্রুতির টাকা পাঠিয়েও দিয়েছিলেন।

সময়টা ছিল ১৮৫৯ সাল। নীলকরদের অত্যাচারে বিধ্বস্ত বাংলা, কৃষকদের অবস্থা খুবই খারাপ। রানিমা জানতে পারলেন, তাঁর জমিদারির অধীনে মাকিমপুর পরগণার চাষিদের উপর নির্মম অত্যাচার করছে ডোনাল্ড সাহেব। প্রজাদের বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। বুদ্ধি বা যুক্তিতে নয়, এবার শক্তিতে লড়তে হবে। ডোনাল্ডের সৈন্যদের শায়েস্তা করতে ৫০ জনের একটি নিজস্ব লাঠিয়ালবাহিনী পাঠালেন রানি। লাঠিয়ালরা মাকিমপুর পরগণায় পৌঁছনোর পর, তাদের সাথে যোগ দিল অত্যাচারিত কৃষকেরা। সবাই মিলে ডোনাল্ড এবং তার পেয়াদাদের পরগণা ছাড়া করে ছাড়ল।

সমাজ সংস্কারক রূপেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রানি। সে সময়ে মেয়েদের নানান দুর্দশা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেকালে প্রায়শই বয়সের অনেক বেশি পার্থক্যে বিয়ে দেওয়া হত। সাত আট বছর বয়সী শিশুর সাথে মাঝবয়সী বিপত্নীক পুরুষ বা বৃদ্ধের বিয়ে দেওয়া হত, কৌলিন্য প্রথার নাম করে। যার ফল ছিল অকালবৈধব্য। এ ধরনের কুপ্রথা সমাজ থেকে দূর করতে এগিয়ে এলেন রানিমা, নিজের বাড়ি থেকেই শুরু করলেন।

জ্যেষ্ঠ কন্যা পদ্মমণিকে ২ বছরের বড় এক কিশোরের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ছক ভাঙলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও বিধবা বিবাহ প্রচলনে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন তিনি। এছাড়াও রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন রানি।

জনকল্যাণকর নানা কাজ, তাঁকে লোকমাতা করে তুলেছিল। সোনাই, বেলেঘাটা ও ভবানীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বাজার নির্মাণ করিয়েছিলেন। আজকের যদুবাবুর বাজারও গড়ে উঠতে শুরু করেছিল তাঁর হাতেই।

কালীঘাটে ঘাট ও মুমূর্ষু রোগী নিবাস, হালিশহরে জাহ্নবী তীরে ঘাট, তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে শ্রীক্ষেত্র পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথও নির্মাণ করান রানিমা। গঙ্গাস্নানের সুবিধা ও বিশ্রামাগার হিসেবে তিনি কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট নির্মাণ করান।

স্নানার্থী এবং পুণ্যার্থীদের বাবুঘাটে পৌঁছনোর জন্য তিনি চৌরঙ্গি থেকে চওড়া রাজপথ তৈরি করান, নাম হয় অকল্যান্ড রোড। এখন সে রাস্তাকে আমরা রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ নামে চিনি। ১৮২৩ সালের বন্যায় জানবাজারের প্রাসাদ থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বন্যাপীড়িতদের জন্য খাদ্য ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিলেন রানি। ঐ সময়তেই স্বামীকে সরকারি অনুমোদন নিয়ে বাবু রোড এবং বাবু ঘাট তৈরির অনুরোধ করেছিলেন রানি রাসমণি। যা সম্পূর্ণ করেন নিজেই।

কলকাতার অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই বাবু ঘাটের নাম তাঁর স্বামীর নামেই নামকরণ করেন, বাবু রাজচন্দ্র দাস ঘাট। হাটখোলা ঘাট এবং নিমতলা ঘাটও তাঁর আনুকূল্যে তৈরি, শবদাহ করার জন্য নিমতলা ঘাটে একটি বড় ছাউনিও তৈরি করিয়ে ছিলেন। কাছেই গড়ে ছিলেন বৃদ্ধাশ্রম।

ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি যা আজ ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার নামে পরিচিত, সেটিরও প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ছিলেন রানিমা। হিন্দু কলেজ অর্থাৎ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রভূত অর্থসাহায্য করেছিলেন।

ধর্মীয় শত্রু অর্থাৎ বিভেদ যা চোখে দেখা যায় না তার, বিরুদ্ধেও লড়তেন রাণী। কেবল শত্রুদমন আর সমাজ সংস্কার নয়! ধর্ম ও বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন তিনি। সেও এক যুদ্ধ! শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল তাঁর দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার। শূদ্রানী মন্দির করবে তা আবার হয় নাকি! সেই অসাধ্যও তিনি সাধন করলেন। ভেঙে দিয়েছিলেন ধর্মের বেড়াজাল। হয়ে উঠলেন লোকমাতা রানি রাসমণি।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...