রাম-অবতারের কারণ কী?

আচ্ছা, রাম ও রাবণের দ্বন্দ্ব কি আর্য ও অনার্যের দ্বন্দ্ব? রাম আর্য, রাবণ অনার্য? 

তা মনে হয়, নয়। বাল্মীকির 'রামায়ণ'-এ সীতাহরণের পর মন্দোদরি একবার রাবণকে বলেছিলেন, 'আপনি এমন অনার্যের মতো আচরণ করছেন কেন?'--রাবণ অনার্য হলে বা অনার্য-সংস্কৃতির প্রতিনিধি হলে নিশ্চয় মন্দোদরি তাঁকে এমন কথা বলতেন না। তাহলে, 'রামায়ণ'-এ রাম ও রাবণের দ্বন্দ্বের উদ্দেশ্যটা কী?

‘মহাভারত’-এর শকুনির মতো ‘রামায়ণ’-এ মন্থরা না-থাকলে গল্পের বৃত্ত কিছুতেই সম্পূর্ণ হত না। তবু, অযোধ্যা, অন্ধকের অভিশাপ, দশরথ, কৈকেয়ী, মন্থরা—সবাই উপলক্ষমাত্র, পাখির চোখ আসলে দাক্ষিণাত্য এবং উপবীতধারী রাজা রাবণ। 

জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ ও ঋষিপুত্র হয়েও, স্বভাবে রাক্ষস রাবণ সংযম শেখেননি। 'রাক্ষস' যেন এক স্বভাবের নাম। যে স্বভাবে ধৈর্য থাকে না, সংযম থাকে না। তাঁরও ছিল না। 

কিন্তু, সীতাহরণের আগে কী এমন অপরাধ করেছিলেন রাবণ, যার জন্য বিষ্ণুকে অবতার নিতে হল? এমন এক অবতার, যিনি হবেন সত্য ও ন্যায়ের মূর্তিমান প্রতিভূ? 

এই সব প্রশ্নমালার প্রেক্ষাপটেই একদিন অযোধ্যায় রাজা দশরথের পুত্র হয়ে চৈত্রের শুক্লা নবমী তিথিতে জন্ম নিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু। দশরথের প্রথম রানি কৌশল্যার গর্ভ বেয়ে রামরূপে ধরায় এসেছিলেন তিনি। এটি তাঁর সপ্তম অবতার। এই অবতারে বিষ্ণু সত্য, কৃপা, করুণা, কর্তব্য--এই চার গুণের আধার হয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। রাবণের মতো রাক্ষসদের বিনাশ করে ধর্মস্থাপনের জন্যই তিনি এই অবতার নিয়েছিলেন। কিন্তু, ‘ধর্ম’ কী? 

ram1

‘ধর্ম’-শব্দের আভিধানিক অর্থ হল, ‘যা ধারণ করে’। ‘ধারণ’-অর্থে ‘আশ্রয়’। ফলে, 'ধর্ম', আসলে আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দেয়। রাম অবতারে ভগবান বিষ্ণু ধরা দিয়েছিলেন ধর্মস্বরূপে, সকলকে ঠাঁই দিতে চেয়েছিলেন তাঁর আশ্রয়ে।

'মহাভারত'-এর ‘বনপর্ব'-এ ঋষি মার্কণ্ডেয় সংক্ষেপে যুধিষ্ঠিরকে রামায়ণকথা শুনিয়েছিলেন। সেখান থেকে জানা যায় যে, পিতৃসূত্রে কুবের ছিলেন রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই। কুবের ছিলেন লঙ্কার অধিপতি। আর তাঁর ছিল সুদৃশ্য এক পুষ্পক বিমান। এই বিমানে মনের গতিতে যথা ইচ্ছা, তথা যাওয়া যেত। 

যে-সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে-সময় তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে রাবণ হয়ে উঠেছিলেন জগতে অজেয়। প্রানের ভয় না-থাকলে জীবের অহং বাড়ে। রাবণেরও বেড়েছিল। তার ওপর রাবণ ভালোবাসতেন আধিপত্য। তাই রাক্ষস স্বভাবে যা-কিছু সুন্দর, যা-কিছু দুর্লভ সমস্তই নিজের করে পেতে চাইতেন। ফলে, একদিন কুবেরের কাছে থেকে গায়ের জোরে পুষ্পক কেড়ে নিলেন, তারপর তাঁকে লঙ্কার সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করে নিজেই হয়ে উঠলেন লঙ্কেশ্বর। 

অপমানিত-বিতাড়িত কুবের যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন, কেড়ে নেওয়া পুষ্পক রথ একদিন রাবণের মৃত্যুকেই বহন করে আনবে! সীতাহরণের মধ্য দিয়ে একদিন সত্যি হয়েছিল সে-কথা। 

তখন সময় এমন একটা পথে চলছিল, যখন মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছিল, ক্ষমতার লোভ তাদের হীন করে তুলছিল, আর দেবতারা প্রমাদ গণছিলেন রাক্ষসদের পদানত হবার ভয়ে! 

পরিস্থিতি যখন এরকম, ঠিক তখনই রাবণ ত্রিলোক জয়ের স্বপ্ন নিয়ে স্বর্গ আক্রমণ করলেন। যথারীতি স্বর্গ জয় করে সেখান থেকে দেবতাদের বিতাড়িত করে রাবণ সেখানে রাক্ষস রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। 

রাজা যদি ধর্মপথ থেকে বিচ্যুত হন, তাহলে তাঁর অনুগামীরাও সেই অধর্মের পথটিকেই শ্রেয় বলে মনে করতে থাকেন। ফলে, রাজা স্বর্গে দেবতাদের প্রতি অত্যাচার শুরু করতেই তাঁর অনুগামীরা শুরু করলেন মর্তে মানুষের প্রতি প্রবল অত্যাচার। সামাজিক জীবন তো বটেই, এমনকি তাদের ধর্মজীবনেও রাক্ষসেরা বার বার আঘাত দিতে লাগল। 

তখন, স্বর্গ ও মর্ত থেকে একযোগে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ রব উঠল। দেবতারা সশরীরে এবং মানুষেরা দেবস্থানে মাথাকুটে আশ্রয়ের দেবতা বিষ্ণুর শরণ নিলেন। ভগবান বিষ্ণু শরণাগতদের কখনই ফেরান না। তখনই তিনি সংকল্প নিলেন অত্যাচারী রাবণকে বিনাশ করে ত্রিলোকে ন্যায়ধর্ম স্থাপন করবেন, নেবেন রাম-অবতার। 

আসলে, মৎস্য, কূর্ম ও বরাহ অবতারে তিনি প্রলয়কালে জগতকে রক্ষা করেছেন,  আর নরসিংহ এবং মানব অবতারে তিনি জগতে স্থাপন করেছেন ধর্ম। পরবর্তী যুগে 'গীতা'-য় কৃষ্ণ অবতারে ধর্মসংস্থাপনের জন্য তিনি যে যুগে যুগে আবির্ভূত হওয়ার কথা বলেছিলেন, সেটাই হচ্ছে আসল কথা।

কারণ, অধর্ম ও অসত্যেই মানুষের সমধিক রুচি, কারণ, তার সঙ্গেই ব্যক্তিস্বার্থের যোগ বেশি। তাই সত্য ও ন্যায়ের দণ্ড ধরে যুগে যুগে কাউকে-না-কাউকে প্রমাণ করতেই হয় যে, সত্য ও ন্যায় ঈশ্বরের মতোই শাশ্বত এবং জীবনে তাই-ই একমাত্র অনুসরণযোগ্য! 'রামায়ণ'-এর মতো মহাকাব্যগুলো যুগধর্মের সঙ্গে সঙ্গে শাশ্বত মানবধর্মেরও পাঁচালিগাথা, তাই সেখানে রাবণ ও রামের দ্বান্দ্বিক আবির্ভাব অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে এই শাশ্বত সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর আবদারে। 

তাছাড়া, সত্য ও ধর্মের বাহকও যে বিভ্রান্ত হতে পারেন, ভ্রষ্ট হতে পারেন; সত্য যে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নিষ্ঠুর নিরপেক্ষ তারও উদাহরণ হয়ে উঠতে হয় রামকে। বালী বধ, শম্বুক বধ, সীতার অগ্নিপরীক্ষা তাঁর সেই বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার উদ্ধৃতি। 'রামায়ণ'-এ এই জায়গায় এসে রাম-রাবণ সকলেই হয়ে ওঠেন উপলক্ষমাত্র। অনুরণিত হয় একটাই দর্শন : সত্য নিষ্ঠুর, তাই সে নিরপেক্ষ, তাই সে অনন্ত সুন্দর...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...