মামলা ঠুকলেন মা, পাল্টা লড়েলেন এবং জিতে দেখিয়েদিলেন রামমোহন। নিজের বাড়ি থেকেই ধর্মীয় গোঁড়ামি বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। সে লড়াই ছিল মায়ের বিরুদ্ধে। যেকোনও সন্তানের কাছেই এ লড়াই বড্ড কঠিন লড়াই। সারাজীবন অনেক লড়াই লড়েছেন রামমোহন। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন লড়াই হয়ত এটাই ছিল, কারণ প্রতিপক্ষ তাঁর জননী।
কিন্তু রামমোহন মানেই যে আপোষহীন সংগ্রাম। শোনা যায় একবার বাপের বাড়ি গিয়েছেন তারিণীদেবী, মায়ের সঙ্গে ছোট্ট রামমোহনও আছেন। পুজো শেষে দাদু শ্যাম ভট্টাচার্য, তাঁর নাতি রামমোহনকে পুজোর নৈবেদ্যের বেলপাতা দিয়েছেন। কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল, রামমোহন ঐ বেলপাতাই চিবোচ্ছেন।
তারিণীদেবী রামমোহনকে কষিয়ে এক থাপ্পড় মেরেই বেলপাতা মাটিতে ফেলে দিলেন। বাবাকে তিরস্কার করলেন, রাগের পাল্টা রাগ হল, আগুনে ক্রোধে মেয়েকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন বাবা, ‘তুই আমার বেলপাতা ফেলে দিলি? তুই এই ছেলেকে নিয়ে সুখী হবি না। এ ছেলে বিধর্মী হবে।’ সেই সঙ্গে দিলেন আশীর্বাদও। বললেন, ‘এ পুত্র রাজপূজ্য এবং অসাধারণ লোক হবে।’
সত্যি সত্যি এ ছেলে হয়ে উঠল অসাধারণ। রাজপূজ্যই নয়, হয়ে উঠলেন রাজা। অ-সাধারণ মানেই যে সাধারণ নয়, আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতো মা-বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটিও আর সাধারণ থাকল না।
অল্প বয়স থেকেই ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধিতা শুরু করলেন রামমোহন। প্রথম জীবনে বাড়ির কুলদেবতা রাধাগোবিন্দের প্রতি বেশ ভক্তি ছিল তাঁর। কৈশোরে সন্ন্যাসীও হতে চেয়েছিলেন রামমোহন। পরে শিক্ষাই আমূল পরিবর্তন ঘটায় তাঁর, কাশীতে গিয়ে সংস্কৃত ও শাস্ত্রের পাঠ নিলেন, পটনায় শিখলেন আরবি। কোরানও পড়লেন। জানলেন বুঝলেন, আর শুরু করলেন মূর্তি পুজো বিরোধী লড়াই।
রামমোহনের পিতা রামকান্ত এবং মা তারিণী দেবী দুইজনই ছিলেন ধর্ম অন্ত প্রাণ মানুষ। রামাকান্ত শেষ জীবনে বৈষ্ণব হয়েছিলেন। শেষে কিনা সেই বাড়ির ছেলে বিধর্মী হবে! ভাবা যায়!
পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করছে ছেলে, মা আর সইতে পারলেন না। তার উপর জুটে গেল কান ভাঙানো, ইন্ধন দেওয়ার লোক। রামমোহনের দাদার ছেলে গোবিন্দপ্রসাদ কাকার বিরুদ্ধে ঠাকুমা তারিণী দেবীর কানে ক্রমাগত ইন্ধন যুগিয়ে যান। যদিও শেষ জীবনে গোবিন্দপ্রসাদ এর জন্য অনুতপ্ত ছিলেন, ক্ষমাও চেয়েছিলেন কাকার কাছে। রামমোহন ও তাঁর বাবার সম্পর্ক এমনিতেই ছিল নড়বড়ে।
রামমোহনের এই সব কাণ্ডকারখানা, পিতা রামকান্তও সহ্য করতে পারতেন না। পৌত্তলিকতা বিরোধী, ‘হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্ম্মপ্রণালী’ বই প্রকাশের পরে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে। তারিণী দেবী কার্যত ছেলে আর বাবার মধ্যে বিভেদ তৈরির কাজ করছিলেন। আর পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলা সম্ভব হল না, রামমোহনের। বাড়ি ছাড়লেন তিনি।
এর বেশ কিছুকাল পরের কথা, একবার খাজনা বাকেয়ার দায়ে মামলা হয়েছিল রামমোহনের বাবা রামকান্তের বিরুদ্ধে। বিচারে দোষী প্রমাণিত হয়ে, হুগলির দেওয়ানি জেলে বন্দী হয়েছিলেন রামমোহনের বাবা। রামমোহনের দাদা, জগন্মোহনও একই অভিযোগে মেদিনীপুর জেলে বন্দী হলেন। রামমোহন তখন ঢাকায়। ঢাকায় থাকাকালীন হঠাৎই রামমোহনের কাছে খবর আসে, তাঁর বাবা মারা গিয়েছেন। শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হল তিনটি। জেলেই শ্রাদ্ধ করেন জগন্মোহন। রামমোহনও আলাদা ভাবে বাবা পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন।
ম্লেচ্ছ বলে ছেলের টাকা নিলেন না তারিণী দেবী। নিজের গয়না বন্ধক রেখে স্বামীর শ্রাদ্ধ করেলেন।
এবার এল সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার পালা, পৈতৃক সম্পত্তির কানাকড়িও ছেলেকে দেওয়ার ইচ্ছে নেই মায়ের।
কারণ, ছেলে বিধর্মী, ম্লেচ্ছ। তাই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী যেন সে না হয়, তার জন্যে আদালতে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেন মা। ছেলে প্রথমে মায়ের বিরুদ্ধে মামলা লড়তে চাইলেন না। কিন্তু পরে ঠিক করলেন, তিনি লড়বেন। কারণ তাঁর লড়াই ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। মামলা উঠল কোর্টে। মা তারিণী দেবী কোর্টের সওয়াল জবাবে বললেন- 'ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক যদি এখানে ছিন্ন করা হয় তাহলে তা আমি অত্যন্ত পুণ্য কাজ বলে মনে করব।' তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন ছেলের প্রতি।
তবে এই মামলার গোটা পর্বে ইন্ধনদাতার ভূমিকায় ছিলেন রামমোহনের সব আত্মীয়েরা।
মামলা তো আর ধর্মীয় ভাবাবেগ বা মায়ের মন মেনে চলে না। ধর্মের কথা বলে জেতাও যায় না, মামলা জিততে দরকার যুক্তি। মামলায় জিতে গেলেন রামমোহন। পেলেন পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার। কিন্তু তিনি তাঁর প্রাপ্য আর সম্পত্তি নিলেন না। সব ফিরিয়ে দিলেন মাকে। বুঝিয়ে দিলেন, সম্পত্তির জন্য মামলা লড়ছিলেন না। লড়ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কারণ, তাঁর যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
যদিও এর অনেক পরে মা এবং ছেলের মধ্যে মিলমিশ হয়ে যায়। জনশ্রুতি রয়েছে; পরবর্তীতে রামমোহনকে তাঁর মা এও বলেন যে, ‘রামমোহন! তোমার মতই ঠিক'।