তখন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আপামর বঙ্গবাসী দিকে দিকে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানে একাত্ম হয়ে রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছেন ইংরেজের ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে। কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন দেশমাতৃকার বন্দনাগান ‘বন্দে মাতরম’। অন্যদিকে বাংলার বীর সন্তানেরা আত্মবিসর্জনের বিনিময়ে স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যজ্ঞে দলে দলে আত্মনিয়োগ করতে শুরু করেছেন। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসকেই করে তুলেছেন হাতিয়ার। এই পথ বেয়েই প্রফুল্ল চাকী আত্মাহুতি দিলেন, ফাঁসির দড়ি গলায় বরণ করলেন বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। হয়ে উঠলেন অকাতর আত্মদানের প্রেরণা।
উত্তাল এই সময়ের ধারা বেয়ে এল ১৯১০ সাল। ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সরোয়াতলী গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে দুর্গাকৃপা বিশ্বাস আর নয়নতারা দেবীর সন্তানরূপে জন্ম নিলেন ভবিষ্যতের এক বীর বিপ্লবী। দুর্গাকৃপা ছাপোষা ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ, তাই ছেলের নাম দিলেন ‘রামকৃষ্ণ’।
রামকৃষ্ণ ছোট থেকেই ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। মধ্যবিত্ত গেরস্থ দুর্গাকৃপার তেমন সামর্থ্য ছিল না গৃহশিক্ষক রেখে ছেলেকে পড়ানোর। তবু তারি মাঝে ছাত্র হিসেবে স্কুলের শিক্ষকদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন রামকৃষ্ণ। শিক্ষকদের মুখে দেশমাতৃকার পরাধীনতার যন্ত্রণার কথা শুনে, স্বাধীনতাকামী বীর সন্তানদের আত্মত্যাগের কাহিনি শুনে তিলে তিলে রামকৃষ্ণের বুকের মধ্যেও জ্বলে উঠতে লাগল বিপ্লবের আগুন। বাসা বাঁধতে লাগল লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষা। হাতে এল বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরামের জীবনী। রামকৃষ্ণের জন্মের মাত্র দু’বছর আগেই মাতৃভূমির জন্য যে কিশোর হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁর কাহিনি পড়ে, মনে জাগল ক্ষুদিরামের মতো আত্মত্যাগের বাসনা।
সেই বাসনা নিয়েই সতের বছর বয়সে ১৯২৮ সালে রামকৃষ্ণ মেট্রিক পাশ করলেন। পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে বৃত্তি পেলেন। দুর্গাকৃপা ছেলের এই কৃতিত্ব দেখে আশায় বুক বাঁধলেন। ছেলে আরও পড়বে, চাকরি করবে, সংসারে উন্নতি হবে। দেখলেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু অলক্ষ্যে নিয়তি হাসলেন।
১৯২৮ সাল। বিপ্লবী সূর্য সেন পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগারটকে হত্যার পরিকল্পনার দায়ে দু’বছর জেল খেটে এই সময় বেলেগাঁও থেকে ফিরলেন চট্টগ্রামে। বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবীদের আদর্শকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠা করলেন বিপ্লবী সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা’। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, হিংসার আশ্রয় নিয়ে ব্রিটিশ শাসকের বুকে ত্রাস সঞ্চার করতে হবে নইলে স্বাধীনতা আসবে না। তাই চাই সশস্ত্র আন্দোলন। যোগাযোগ করলেন সশস্ত্র সংগ্রামের গুপ্তকেন্দ্র ‘অনুশীলন সমিতি’র সঙ্গে। ব্রত নিলেন সেনাদল তৈরি করে সম্মুখ সমরের।
শুরু হল সেনা সংগ্রহের কাজ। যাদের বুকে আগুন আছে, দেশের প্রতি ভালোবাসা আছে, তাদের এক ছাতার তলায় আনার কাজ শুরু হল। মাস্টারদার নির্দেশে গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং প্রমুখ বিপ্লবীদের মাধ্যমে শুরু হল সেনাসংগ্রহের কাজ। এই সময়ই তাঁদের দলে নাম লেখালেন বছর বিশের তরুণ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস।
রামকৃষ্ণ তখন চট্টগ্রামের সরকারী কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছেন। পাথরঘাটায় বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করছেন। বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগ দেবার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই রামকৃষ্ণ তাঁর নিষ্ঠা ও দেশভক্তির জন্য মাস্টারদার নজরে পড়লেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে এলেন। রামকৃষ্ণ বিজ্ঞানের ছাত্র, তাই মাস্টারদা তাঁকে বোমার খোল তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার কাজে লাগিয়ে দিলেন। পুরো দমে চলতে লাগল কাজ। চলতে লাগল পাহাড়তলিতে চাঁদমারি তৈরি করে বন্দুক রিভলভার চালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়াও।
মাস্টারদা এবার প্রস্তুতি শুরু করলেন সশস্ত্র সংগ্রামের। সংগ্রামের জন্য প্রয়োজন প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। তাই সেসব সংগ্রহের জন্য পরিকল্পনা করলেন ইংরেজের চট্টগ্রামের অস্ত্রাগারটি লুঠ করার। তার দিনক্ষণও ঠিক করে ফেললেন। আইরিশ বিপ্লবের দিন, ১৮ এপ্রিল।
আক্রমণের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, তারকেশ্বর দস্তিদার, অর্ধেন্দু দস্তিদার নিযুক্ত হলেন বোমা তৈরির কাজে। কিন্তু তারই মধ্যে একদিন ঘটে গেল দুর্ঘটনা। বোমা তৈরির মশলায় অতর্কিতে আগুন লেগে গেল। ভয়ানক সেই আগুনে তিনজনই মারাত্মক পুড়ে গেলেন। অনন্ত সিংহ খবর পেয়ে বেবি অস্টিন গাড়িতে করে লুকিয়ে নিয়ে গেলেন এক সদস্যের বাড়ি। ব্যবস্থা হল চিকিৎসার। কিন্তু রামকৃষ্ণের ভগ্নিপতি ছিল সরকারী চাকুরে। পদন্নোতির লোভে সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পুলিশে খবর দিয়ে দিল। রামকৃষ্ণের গুপ্ত বিপ্লবীর পরিচয় ব্যক্ত হয়ে পড়ল। পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করল। শুরু হল অসুস্থ ও আহত রামকৃষ্ণের পলাতকজীবন। পালাতে পালাতে শেষমেশ আশ্রয় পেলেন কর্ণফুলী নদীর পারে শ্রীঘর গ্রামে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অভিযান হল, লুণ্ঠিত হল পাহাড়তলীর অস্ত্রাগার। পরবর্তী চারদিন চট্টগ্রাম মুক্ত রইল ইংরেজের অপশাসনের হাত থেকে। তারপরই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শহীদ হলেন বারো জন বীর বিপ্লবী, অনেকেই ধরা পড়লেন, অনেকেই পালাতে সক্ষম হলেন। প্রতিশোধ নিতে ইংরেজের পুলিশ পলাতকের খোঁজে শুরু করল অত্যাচার, ধৃতদের প্রতি শুরু করল নির্যাতন আর মৃত-অর্ধমৃতদের জ্বালিয়ে দিল পেট্রোল দিয়ে।
ওদিকে বিপ্লবী বিনয় বসু ১৯৩০ সালের ২৭ আগস্ট কলকাতায় মিটফোর্ড হাসপাতালে পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যানকে হত্যা করলে তার জায়গায় নতুন পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন টি জে ক্রেইগ। এই ক্রেইগ এই সময় কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে এলেন অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাটির তদন্ত করতে। মাস্টারদা ঠিক করলেন ফেরার পথে ক্রেইগকে হত্যা করবেন, তাকে আর ফিরতে দেওয়া যাবে না। পর পর দুই পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেলের এভাবে মৃত্যু হলে ইংরেজের অন্দরে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। মাস্টারদা নিজে শ্রীঘর গ্রামে এসে রামকৃষ্ণকে দিলেন ক্রেইগ হত্যার দায়িত্ব। এই কাজে রামকৃষ্ণের সঙ্গী হলেন কালীপদ চক্রবর্তী।
ডিসেম্বর মাস। পয়লা ডিসেম্বর। আকাশে-বাতাসে শীতের কাঁপন লেগেছে। তাই রামকৃষ্ণ গায়ে দিলেন একখানা লাল চাদর; আর কালীপদ গায়ে দিলেন একখানা নীল চাদর। দুটো বোমা আর দুটো ওয়েভলি রিভলবার সেই চাদরের নীচে সহজেই লুকিয়ে ফেলে মাষ্টারদার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তাঁরা ক্রেইগ হত্যার জন্য রওনা দিলেন।
রাতের অন্ধকারে কর্ণফুলী পেরিয়ে কাতালগঞ্জ পার হয়ে দু’জনে এসে পড়লেন কুমিরা স্টেশনে। খবর আছে আজ রাত্রের ট্রেনেই ক্রেইগ চলেছে কলকাতার পথে। আজ তাকে কিছুতেই ফিরতে দেবেন না রামকৃষ্ণরা। প্রয়োজন হলে কলকাতা পর্যন্ত ধাওয়া করে মারবেন। শুরু হল অপেক্ষার ক্ষণ। রাত্রি ন’টা সারে ন’টার সময় ট্রেন এল। নিশ্চিত খবর পাওয়া গেল এই ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরাতেই ক্রেইগ রয়েছে। কিন্তু উপায় নেই, সেই বিশেষ কামরা ভেতর থেকে বন্ধ। বাইরে অস্ত্রধারী গার্ড। সুযোগের অপেক্ষায় ট্রেনে উঠে বসলেন রামকৃষ্ণ ও কালীপদ। মাঝরাত্রে ট্রেন এসে থামল লাকসামে।
সেখানে ট্রেন থেকে নেমে ক্রেগের ঠিক পাশের সাধারণ কামরায় এসে উঠলেন দুজনে। সেখান থেকে ট্রেন চাঁদপুরে এসে থামল, তখন ভোর প্রায় চারটে। এই সময় সুযোগ মিলে গেল হঠাৎ। দেখা গেল ক্রেইগের কামরার দরজা খোলা। দরজায় কোর্ট পরা এক লম্বা মানুষ পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে তাকে ক্রেইগ বলেই মনে হচ্ছে। যেমন বর্ণনা শোনা গিয়েছিল, তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আর দেরি নয়, মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে গেলেন দুজন, ঝট করে পিছন থেকে রিভলবার বার করে অব্যর্থ নিশানায় কালীপদ গুলি করলেন লোকটাকে।
মুহূর্তে বাংলায় আর্তনাদ করে লোকটা পড়ে গেল। তাই দেখে দ্বিতীয় গুলিটা করতে গিয়েও থমকে গেলেন রামকৃষ্ণ। লোকটা যে বাঙালি! ক্রেইগ নয়! ক্রেইগের পরিবর্তে এ কাকে হত্যা করলেন তাঁরা! ক্রেইগ কোথায়!
ওদিকে বিপদ বুঝে সঙ্গে সঙ্গে সান্ত্রীরা বন্ধ করে দিয়েছে কামরার গেট। শুরু হয়ে গেছে শোরগোল আর প্রতি আক্রমণের উদ্যোগ। আর উপায় নেই বুঝে লাইন টপকে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন দুজনে। এদিক ওদিক খানিক ছোটাছুটি করে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিক ঠাহর করতে না-পেরে ঘণ্টাখানেক পরে আবার ফিরলেন চাঁদপুর স্টেশনে। স্টেশনে ফিরে দেখলেন, চারিদিকে তখন একেবারে শুনশান। মাস্টারদা তাঁদের যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তা ব্যর্থ হয়েছে। দুজনেরই মন ভীষণ খারাপ তাতে। ঠিক করলেন চট্টগ্রামেই ফিরবেন। রেললাইন ধরে সেদিকেই তাঁরা হাঁটতে শুরু করলেন।
হাঁটতে হাঁটতে সকাল হল। তখন লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে খবর। চাঁদপুরের এসডিও তারিণী মুখার্জি স্টেশনে খুন হয়েছেন। রামকৃষ্ণরা সেখান থেকেই সত্যটা জানলেন।
তখন সকাল দশটা প্রায়। জি টি রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুজনে যখন মেহেরকালী স্টেশনের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছেন, তখন একটা পুলিশের ভ্যান রাতায় টহলদারি করতে গিয়ে তাঁদের সন্দেহ করল। দুজনকে থামাল। পালানোর কোন উপায় রাখল না। তল্লাশিতে বেরিয়ে পড়ল রিভলভার আর বোমা। অমনি রামকৃষ্ণদের তুলে এনে বন্দি করল কুমিল্লা জেলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের লাল-নীল দুই চাদরের রঙ দেখে শনাক্ত করল।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক গভীর রাতে রামকৃষ্ণ ও কালীপদকে গোপনে নিয়ে আসা হল কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে তাঁদের জায়গা হল চোদ্দ নম্বর সেলে।
২৮ ডিসেম্বর থেকে কলকাতা হাইকোর্টে শুরু হল রামকৃষ্ণ ও কালীপদর বিচার। মেঘনাদ মিত্র ও বি সি চৌধুরী নামের দুই ব্যারিস্টার এগিয়ে এলেন দুজনের হয়ে সওয়াল করতে। কিন্তু স্বয়ং ক্রেইগ এসে যখন মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে দুজনকে শনাক্ত করলেন, তখন আর তাঁদের করার কিছু রইল না। বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয়ে গেল। ইংরেজ শাসক চাইল দুজনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে। কিন্তু আঠারো বছরের কম বয়সী কাউকে ব্রিটিশ আইনে ফাঁসি দেওয়া যায় না। রামকৃষ্ণের বয়স কুড়ি, কালীপদর সতের। তাই ১৯৩১ সালের ২৪ জানুয়ারি আদালত কালীপদকে দিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আর রামকৃষ্ণ বিশ্বাসকে দিল ফাঁসির হুকুম। দুই ব্যারিস্টার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করলেন, কিন্তু তারাও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলেন।
মামলা চলতে চলতে গ্রামের বাড়িতে দিনের পর দিন পুলিশের হুমকি-নির্যাতনে বাবা মারা গেলেন। তারপর মা-ও মারা গেলেন একদিন।
রামকৃষ্ণের কোন আত্মীয় কোন স্বজন আসেননি এই সময় জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন সুদূর চট্টগ্রামের সরোয়াতলী থেকে ছেলেকে দেখতে আসার মতো না-আর্থিক না-শারীরিক কোন সামর্থ্যই তাঁদের ছিল না।
এই সময় মাস্টারদার দলে যোগ দিলেন বেথুন কলেজের ছাত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি মাস্টারদার মুখে, বিপ্লবী সতীর্থদের মুখে নির্ভীক রামকৃষ্ণের কথা শুনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। অমিতা দাস ছদ্মনামে রামকৃষ্ণের পিসতুতো বোন পরিচয় দিয়ে সাত মাসে চল্লিশবার সাক্ষাৎ করলেন। রামকৃষ্ণের মুখে নির্ভীক বিপ্লবের বাণী শুনে তাঁর আগ্রহ জাগল দেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে। আর সে-কথাই অকপটে লিখলেন তিনি নিজের ডায়রিতেঃ
“তাঁর গাম্ভীর্যপুর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদীমন এবং প্রগাঢ় উপলব্দিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল। আগের তুলনায় আমি দশগুণ বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল।”
রামকৃষ্ণ জানুয়ারি মাস থেকেই বারে বারে ম্যালেরিয়ায় ভুগছিলেন। সেই জন্য বার দুয়েক তাঁর ফাঁসি স্থগিত হয়েছে। কেননা, অসুস্থকে ব্রিটিশ আইনে ফাঁসি দেওয়া যায় না। কিন্তু ইংরেজের আইনরক্ষকদের আর বিলম্ব সহ্য হল না। তারা ১৯৩১ সালের ৪ আগস্ট রাতারাতি অসুস্থ অবস্থাতেই রামকৃষ্ণকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিল।
রামকৃষ্ণ আত্মদানের মাধ্যমে চেয়েছিলেন বিপ্লবের প্রেরণা তরুণ-তরুণীদের মনে ছড়িয়ে দিতে। সে কাজে তিনি পূর্ণ সফল হয়েছিলেন। প্রীতিলতার মতো শিক্ষিতা নারী তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, বরণ করে নিয়েছিলেন আত্মত্যাগী বিপ্লবের পথ। আর পথ এই বেয়েই কালান্তরে প্রবাহিত হয়েছে দেশমাতৃকার মুক্তির সাধনা। তাই রামকৃষ্ণ বিশ্বাস শুধু বিপ্লবী নন, আত্মত্যাগের এক বিজয় কেতন। বিস্মৃতির আড়াল সরিয়ে যে কেতন এখনও গৌরবের আকাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে রয়েছে।