"তুমি কি করতে এখানে এলে, এতো সব করে ফেলেছো। আর কি শিখবে?" বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত-অজ গাঁয়ের দীনহীন একটি ছেলে ১৯২৫ সাল নাগাদ তার আঁকা কয়েকটি ছবি সঙ্গে নিয়ে যখন শান্তিনিকেতনে কলাভবনের ছাত্র হওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে সেখানকার এক দিকপাল মাস্টারমশাইকে দেখাচ্ছে, সেই সময় মাস্টারমশাই সেই ছেলেটির হাতের কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাকে বলেছেন একথা। মাস্টারমশাইয়ের চোখ বলে কথা, তিনি সেদিনই অন্তর্দৃষ্টিতে বুঝেছিলেন এ ছেলে নিশ্চয়ই একদিন হয়ে উঠবে আপামর বাংলা, সমগ্র দেশ তথা গোটা বিশ্বের অনন্যতম শিল্প-কারিগর, শিল্প-বাহক। সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকপাল মাস্টারমশাইটি ছিলেন নন্দলাল বসু এবং ছাত্রটি- রামকিঙ্কর বেইজ।
সেই ছেলেবেলা থেকেই রামকিঙ্করের মনে একটি বাসনা বাঁধা ছিল দৃঢভাবে- 'যেখান দিয়ে যাব রাস্তার ধারে-ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো, বর্ষণাতুর আকাশের তলায় বড় মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।' সেই স্নায়ুতাড়িত মনোবাসনার সূচনা তিনি করেছিলেন শান্তিনিকেতনেই। তেলরঙ, জলরঙ, ড্রইং, স্কেচ, ভাস্কর্য -অক্লান্তিতে এ সবকিছু করে গিয়েছেন সেখানেই। তাঁর ছবির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গতিময়তা। শুধু ছবি নয় তাঁর ভাস্কর্যেও পাওয়া যেত একই দৃষ্টান্ত। তিনি তাঁর প্রায় প্রত্যেকটি ভাস্কর্যতে সমসময় মুক্ত আকাশের নীচে প্রানদান করেছেন, বদ্ধ পরিবেশ একেবারেই মেনে নিতে পারতেন না তিনি। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি, আলো-হাওয়া মেখে সব অবস্থান করবে, এই ছিল তাঁর ইচ্ছে। ইউক্যালিপটাসের গাছের সারির ভেতর 'সুজাতা' কিংবা কলাভবনের 'সাঁওতাল পরিবার', 'বাতিদান' পারিপার্শ্বিকে মিলেমিশে আজও এক অদ্ভুত দ্যোতানা সৃষ্টি করে। তাঁর মতে, 'আকাশের তলায় মূর্তি রচনা। কার মূর্তি কীসের মূর্তি তার নির্দেশ প্রকৃতির এবং শিল্পীর নিজের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেই ধরা পড়ে।'
তিনি ছিলেন সুদূর পথের অভিযাত্রী, সময়ের থেকে অনেক এগিইয়ে ছিল তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারনা। তাঁর ছবি-ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় নি এমনটা নয়, যেমনটা আমরা দেখেছি গ্যালিলিও, সক্রেটিস, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভ্যান গখ, পল গগ্যাঁ, স্ক্রিমিনস্কি -বিশ্ববিখ্যাত এ সমস্ত শিল্পীদের শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও। বিষয়কে খুঁটিয়ে দেখে নাড়িয়ে চাড়িয়ে তা অভাবনীয় ভাবে পেশ করা শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে এবং সময়ের বাঁধাধরা নির্মিত নিয়মকে ভাঙাই হল শিল্পীদের কাজ, তাঁদের মতো অসংখ্য শিল্পীই তা করেছিলেন, করে চলেছেন এবং বলাই বাহুল্য 'বিতর্কিত' বলে উল্লেখিত-অবহেলিত হয়েছিলেন, এখনও হন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন কিছু কিছু কাজে আশ্রমিকদের অনেকেই আপত্তি তুলেছিলেন, তবে তা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ মাস্টারমশাই নন্দলালের প্রশ্রয় এবং রামকিঙ্করের নিজের একরোখা মনোভাবের জন্য বেশি সুবিধে করে উঠতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে তাঁর 'ধানঝাড়া' ভাস্কর্যটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই ভাস্কর্যটির উন্মুক্ত শারীরিক প্রকাশের জন্য সেসময় তাঁর গোঁড়া সমালোচনা করেছিলেন; কিন্তু রামকিঙ্করের স্বগোক্তিতে উঠে এসেছে, 'বন্ধুগণ, আমি একজন অতি সংকীর্ণ অথচ বিরাট পথের মুক্তিপথিক। সাধনা ছাড়া এ শিল্পের পথে চলা অসম্ভব। প্রায় সকল সাধনার পথ একই, যদিও সাধনার পথই বিরুদ্ধশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ একটি ছদ্মবেশী কুহেলিকা স্বাধীন মানসিকতাকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করে। তাদের হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টায় একটি নিরন্তর দুর্ভাবনা থাকে......লীলায়িত প্রাণ উৎসের পাশে ছন্দোবদ্ধ কাঠামোর জন্ম মৃত্যুর খেলা কী সুন্দর! দেখতে দাও। কী আঁকব? মূর্তের কী গড়ব? তবু ছাড়বে না পাগলের প্রলাপের মতন।'
রামকিঙ্করের জন্ম ১৯০৬ সালের ২৫ মে। তাঁদের পারিবারিক পদবী ছিল প্রামাণিক। রামকিঙ্করই প্রথম বেইজ পদবি চালু করেন তাঁদের পরিবারে। ক্ষৌরকর্ম ছিল তাঁদের পারিবারিক পেশা। পদবির মতো তিনি পাল্টে দিয়েছিলেন তাঁদের পারিবারিক পেশা-প্রথা। গ্রাম্য পরিবেশ আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মন ছিল তাঁর, শুধু সুযোগ খুঁজতেন আর ভালবাসতেন একাগ্র হয়ে ছবি আর ভাস্কর্য গড়তে। শোনা যায় আর্থিক অনটনের কারনে কিশোর রামকিঙ্করের হাতে নরুণ দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হত গাছতলায়, সেই নরুণ দিয়ে নাপিতের ভূমিকা না পালন করে তিনি গাছের গায়ে ছবি অনুবাদ করতেন। মাটির পুতুল, মূর্তি বানিয়ে মেলায় বিক্রি করতেন। সারাজীবন শুধু কাজ করে যাওয়ার জন্য কখনও সংসারী হতে চাননি। তাঁর কথায়-'শিল্পীরা স্বভাবতই গরিব হয়ে থাকেন, কারণ অহৈতুকী কাজের তাড়নাই তাদের গরিব করে রাখে। সেই জন্য রসিক বিদ্বৎজনের দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়, তা হোক, দুজনের বোঝাপড়ার মধ্যেই হয়ে যায়। তাই হয়ে চলেচে...... গরিবের শিল্পী-ছেলের কল্পনা।। একটা পথ খোলা রয়েছে- সংসারের মধ্যে না ঢোকা। বিবাহ ইত্যাদি বিসর্জন। মা-বাবার প্রতি অকৃতজ্ঞ ছিলাম না অবশ্য।'
সেই অহৈতুক সাধনার সাধকের জন্মদিন আজ, যিনি নির্বাক নিশ্চল মূর্তিতে ঢেলে দিয়েছিলেন সঞ্জীবনী সুধা আর নিজেও আজীবন মজেছিলেন নির্বাক-মূর্তের সাধনায়।