সহজিয়া জীবনের রামকিঙ্কর

নদী, বন, রাঙা মাটির গাঁ আর মেঠো পথ ধরে শান্তিনিকেতন আশ্রমে এসে ঠাঁই নিয়েছিল বছর ঊনিশের এক ময়লা কিশোর কিঙ্কর। পুরো নাম রামকিঙ্কর বেইজ। বাড়ি সেই লাল মাটির দেশে, বাঁকুড়ার যুগী পাড়া। সেখানে অনন্ত দাদার রঙ তুলির টান তাকে পাগল করে দিত। চলকে ওঠা রঙের ভাঁজে রেখায় দ্রিমি দ্রিমি সুর।সদ্য কিশোর ছটফট করত ভিতর ভিতর। রঙের ঘোর, মাটির টান তাকে স্থির থাকতে দিত না। একদিন অনন্ত দাদাকে দেখে দেখেই মূর্তির টান দিতে শিখে গেল আঙ্গুল।

স্বদেশী যুগে পোস্টার আঁকত সে। একদিন চোখে পড়ে গেল প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের চোখে। তাঁর হাত ধরেই ১৯২৫ সালে বাঁকুড়ার যুগি পাড়া ছেড়ে রাঙ্গাপথে শান্তিনিকেতন। গুরুদেবের আশ্রমে।

রাম কিঙ্কর বেইজ ছাত্র হলেন বিশ্বভারতীর। ঠাঁই পেলব কলাভবনের 'ক্লাসরুমে'। মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু। তাঁর কাজ দেখে বলেছিলেন, ‘ তুমি তো সবই জান, আবার এখানে কেন!’

তবু থেকে গেলেন রামকিঙ্কর। মাস্টারমশাই তাঁকে দু-তিন বছর থেকে যেতে বলেছিলেন। সেই তাঁর চিরকালীন হয়ে গেল। ভুবনডাঙ্গার চাঁদ মিশে গেল তাঁর বাকি জীবনের বসন্তে। যেন নিয়তি নির্দিষ্ট টান। আর রবীন্দ্রনাথ। রামানন্দ তাঁর কাছেই এনেছিলেন রংতুলির কিঙ্করকে।

 রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখাটি যেন রামকিঙ্করের সেই নিয়তির ই সম্ভাষণ। একদিন রবীন্দ্রনাথ ডাক পাঠালেন তাঁকে। কবির সামনে স্মিতবাক আনকোরা ছেলেটিকে বললেন, শোন, কাছে আয়। তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে

গুরুদেব দেওয়া কথা তিনি  আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি—

রবি আর লালন সাঁই মুখে গিয়েছিল জীবনের মাটিতে। অনেক দূর ফেলে আসা গন্ধেশ্বরীর ঢেউকে যেমন বুকের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতেন ঠিক সেভাবেই। জলের সুর ভেসে উঠত কন্ঠে। গান গাইতেন। মাথার ওপর খোলা আকাশ। সুর ভেসে যেত দূর থেকে দূরে। ভুবনডাঙ্গা পেরিয়ে দিক চক্রবালে।

গুরুদেব যে কাজের দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিল তিনি তা পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। শিল্পীর শিল্প ছাড়া যে আর কোনও দায় নেই। জীবনকে আগলের বাঁধ দেননি। সে আপন গতিতে বয়ে গিয়েছে। কখনও মোরাম বিছানো পথে কখনও বা জলের রেখার পাকে পাকে। মাটিতে, সিমেন্টে, রঙেতে, তুলিতে নতুন বিস্ময়ে আশ্রম ভরে দিয়েছেন তিনি। কলের বাঁশি, সাঁওতাল পরিবার, ধান ঝাড়াই, সাঁওতাল ও মেঝেন সব কাজেই উঠে এসেছে সাধারণ জীবন।বৃক্ষের আদলে তৈরি করেছিলেন সুজাতাকে। তবে রামকিঙ্করের চিত্র শিল্পী পরিচয় যেন কিছুটা আড়াল হয়ে গিয়েছিল ভাস্কর হিসেবে তাঁর পরিচিতিতে। যে জীবনকে দেখে তাঁর বড় হয়ে ওঠা, যে জীবন আঁকড়ে তিনি বেঁচে থাকতেন সেই জীবনকেই তিনি শিল্পে উপস্থাপিত করেছিলেন।

কাজ শেষে ঘরে ফিরছে এক সাঁওতাল পরিবার, নারীর কাঁধ থেকে ঝোলানো দড়ির খাঁচায় শিশু, রোজকার জরুরি জিনিস বহন করছেন দম্পতি আর সঙ্গে পোষা কুকুর। এ ছবি যেন চিরন্তন।

দেশিয় এবং বিদেশী শিল্প রীতি নিয়ে বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু নিজের কাজ একেবারেই লোকজ তা বিদেশী ধারার প্রভাবে প্রভাবিত নয় সে বিষয়টিও স্পষ্ট করেছিলেন তিনি। নন্দলাল বসুর ছাত্র হয়েও ছিলেন স্বকীয় এবং স্বতন্ত্র।

তিনিই ভারতীয় ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে প্রথম স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি করেন।

কিন্তু কবিগুরুর দর্শন সেখানে পুরোমাত্রায় বজায় ছিল। জীবনের শুরুতে যে মন্ত্র তিনি কবির কাছে পেয়েছিলেন তা হৃদয়ে ধারণ করে চলেছিলেন আজীবন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...