সময়টা নব্বই ছুঁই- ছুঁই। তখনও ভারতের ঘরে ঘরে টিভি আজকের মতো এমন সহজ লভ্য হয়ে যায়নি। তবু রবিবার এলেই শুনশান হয়ে যেত রাস্তা-ঘাট।
যে সব বাড়িতে টিভি আছে তারা আলাদা কদর পেত প্রতিবেশীদের কাছে। রবিবার সকাল হলেই টিভির ঘরে গোটা পাড়া। ৩৫ মিনিটের টানটান উত্তেজনা। নির্মল আমোদ। অরুণ গোভিল আসলে আর কেউ না, ধরা ধামে নররূপী অবতার 'রাম'। কোনও কোনও বাড়িতে আবার যেমন তেমন করে আসা যেত না টিভির সামনে। স্নান সেরে, শুদ্ধ বস্ত্রে তবেই ছাড় মিলিত টিভির সামনে বসার।
গুজরাটের উমারগাঁও এর যেখানে শুটিং চলত সেখানে রামজিউ কে দেখতে ঝেঁপে ভিড় করত গ্রামের মানুষ। অনেকে আবার সম্মুখে জলজ্যান্ত রামচন্দ্র ভগবানের সাক্ষাৎ পেয়ে মাথা ঠুকে প্রণাম করার সুযোগ ছাড়তেন না।
মিরাটের বাসিন্দারা দল বেঁধে আবেদন জানিয়েছিল বিদ্যুৎ সংস্থার কাছে, রামায়ণ চলাকালীন যেন লোডশেডিং না হয়। বদলে অন্য যে কোনও সময়ে লোডশেডিং হোক!
এমন রূপকথার সাফল্য সহজ পথে আসেনি। বড় পর্দার হিট ছবির নির্মাতা- পরিচালক যখন টেলি দুনিয়ায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনেকেই ভেবেছিল বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তাঁর। তার ওপর ভাবনায় ছিল 'মিথোলজি'। চেনা- অচেনা কেউ রাজী হননি 'মুকুট-মুছ'এ বাজি ধরতে। তবু সেই পথেই এল মিথ হয়ে যাওয়া সাফল্য। সময়টা ১৯৮৭। জানুয়ারি সবে পড়েছে। দিল্লির মাণ্ডি হাউস থেকে সক্কাল সক্কাল একটা ফোন পেলেন রামানন্দ চোপড়া।
" দু' সপ্তাহের মধ্যে রামায়ণের পাইলট প্রজেক্ট জমা দিতে পারবেন দূরদর্শনে?"
খুব বেশি কিছু ভাবার সুযোগ তিনি পাননি। এককথায় বলে দিলেন 'হ্যাঁ'।
রামানন্দ চোপড়া তখন বড় পর্দার দুনিয়াকে স্বেচ্ছায় বিদায় জানিয়ে পা রেখেছেন ছোট পর্দার জগতে। বোম্বাইয়ের এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে তিনিই ' রামানন্দ সাগর'। ছেলে প্রেম সাগর সেদিনের গল্প বলতে গিয়ে বলেন, ' বাবাকে বলেছিলাম, আমরা বড় জোর ৪ এপিসোড শ্যুট করে রাখতে পারি ২ সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু এত সময়ের মধ্যে পাইলট প্রজেক্ট একরকম অসম্ভব!'
কিন্তু এমন অসম্ভবটাই সম্ভব করেছিলেন রামানন্দ সাগর। ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। নির্ধারিত ডেডলাইন মেনেই দূরদর্শনে জমা পড়ল পাইলট প্রজেক্ট। জানুয়ারির ২৫ তারিখ দূরদর্শনের পর্দায় সম্প্রচারিত হল রামায়ণের প্রথম পর্ব।
তুলসী দাসের রামায়ণের আদলে লেখা কাহিনী লিখেছিলেন রামানন্দ সাগর নিজে। পরিচালক ও তিনি। মিউজিক করেছিলেন রবিন্দর জৈন।
৩৫ মিনিটের পর্ব প্রথম দিন থেকেই রামজ্বরে কাবু করে ফেলেছিল ভারতীয় দর্শকদের। ৭৮ পর্বের 'রামায়ন' ধারাবাহিকে রামচন্দ্রের ছোটবেলা থেকে শুরু হয়ে রামচন্দ্রের সিংহাসন আরোহণ এবং রাম রাজত্বের শুরু, এখানেই শেষ হয় কাহিনী। সীতার অগ্নি পরীক্ষা, লব- কুশ পর্ব সচেতন ভাবেই বাদ রেখেছিলেন রামানন্দ তাঁর কাহিনীতে।যখনই এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তেন, তখন বলতেন, ' মেরা রাম আয়েসা নেহি কর সকতা'। রামচন্দ্রের ভূমিকায় অরুণ গোভিল, সীতার ভূমিকায় দীপিকা চিকলিয়া, হনুমানের ভূমিকায় দারা সিং। ধারাবাহিকের জন্য অভিনেতা- অভিনেত্রীদের নির্বাচন করা হয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। রামানন্দ সাগরের আগের প্রোডাকশন ' বিক্রম বেতাল' ধারাবাহিকের পুরো টিম কাজ করেছিল। কেবল সুগ্রীব এর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছিলেন তাঁর মাত্র ৭ দিনের প্রস্তুতিতে ক্যামেরার সামনে আসা। প্রেম সাগরের কথায়, ' আমাদের কারও দম ফেলার ফুরসৎ ছিল না।'রামায়ণের সম্প্রচার রাতারাতি বদলে দিয়েছিল ভারতীয় দুরদর্শনের ধারাকে। দেশের মাটিতে ব্লক ব্লাস্টার হিট! ৫৫ টি দেশে ৬৫ কোটি দর্শকের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।
কয়েকটা এপিসোডের পর থেকেই এই ধারাবাহিক আলাদা ' সেনসেশন'।
রামায়ণকে পর্দায় আনার ভাবনাটা শুরু হয়েছিল অনেক কাল আগে থেকেই। কিন্তু টালবাহানা এবং নানা দ্বন্দ্বে বারবার খারিজ হয়ে যায় সেই পরিকল্পনা।
প্রান্ত আশির দশকে রামায়ণের এক এক পর্বের বাজেট ছিল ৯ লক্ষ টাকা। দুরদর্শনের আয় হয়েছিল প্রায় ২৩ কোটি টাকা।
নব্বই দশকের উত্তাল সময়ে রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ' নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। আগুনে সময়ের অনুঘটক হয়ে ওঠার সব মসলা মজুদ বলেও উড়ে এসেছিল তির। তবু ভারতীয় গণদেবতা তুষ্ট হয়েছিল এই ধারাবাহিকে। আসমুদ্র হিমাচল হেসে কেঁদে সঙ্গী হয়েছিল রামরাজার।
এতদিন পর্যন্ত যে কাহিনী বই এর পাতায়, ছবিতে দেখতে অভ্যস্ত ছিল মানুষ সেই কাহিনীর কল্প চরিত্রদের যখন সচল পর্দায় রক্ত মাংসের হয়ে উঠতে দেখল তখন একাত্ম বোধ করেছিল তারা। আপন করে নিয়েছিল প্রতিটি চরিত্রকে।
প্রায় তিন দশক পার করা রামানন্দীয় রামায়ণ সম্প্রতি আবার ফিরে এসেছে দুরদর্শনের পর্দায়। এবার মানুষ ঘরবন্দী। তবে ধারাবাহিক দেখার আনন্দে নয়, প্রাণ বাঁচানোর দায়। করোনার লকডাউন ঘরে আটকে থাকা মানুষকে 'রিলিফ' দিতে নয় অবতারে দুরদর্শনে ফিরে এসেছে রামায়ণ।
আগামী সপ্তাহে শুরু হতে চলেছে সম্প্রচার। এবারের ছক্কা হাঁকিয়েছে রাম-সীতার গপ্পো। ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের রিপোর্ট অনুযায়ী চারদিনে ভিউয়ারশিপ ১ কোটি ৭০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে এর মধ্যেই। এ যেন টাইম মেশিনে চেপে কয়েক দশক পিছিয়ে যাওয়া। আবার বসার ঘরে পরিবারের ভিড়। আলসেমি গায়ে মেখে নস্ট্যালজিয়ায় ডুব। টিভির পর্দায় রাম- লক্ষণ-সীতা।