মুঘল যুগে এবং সুলতানি আমলে হিন্দু-মুসলিম সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে, আচার হিসেবে ইতিহাসে রাখি ব্যবহারের কথা আমরা জানতে পারি। শোনা যায়, সেকালে হিন্দু রাজপুত-রানিরা মুঘল বাদশা ও সুলতানদের কাছে রাখি পাঠিয়ে ভাইবোনের সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। কিন্তু, সে তো উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রাখি-কালচারের উদাহরণ। সর্বভারতীয় তো নয়।
সুতরাং এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পূর্ব ভারতের বঙ্গদেশে রাখি-বন্ধনের এই যে প্রবহমান ঐতিহ্য, সেটি এল কোথা থেকে?
এল, সেই মুঘল ও সুলতানি ঐতিহ্যের উদাহরণ থেকেই। নিয়ে এলেন বাংলার এক যুগপুরুষ, রবীন্দ্রনাথ। এই নিয়ে আসারও একটি প্রেক্ষাপট আছে। ব্যাপারটা এক নিদারুণ সময়ের দারুণ ঘটনা:
সময়টা, গত শতকের প্রথম দশক। ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। পয়লা সেপ্টেম্বর একটি মারাত্মক রাজকীয় ঘোষণা হল। ঘোষণায় বলা হল যে, ১৬ অক্টোবর অখন্ড বাংলাকে ভাগাভাগি করে প্রতিবেশি রাজ্যগুলোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে!
ঘোষণাটি শুনে বাংলার সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ শুধু নড়েচড়েই বসলেন না, ভয়ানক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। সেই ক্ষোভের মুখেই বঙ্গভঙ্গের এই ভয়ানক চক্রান্তের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন শুরু করলেন নেতারা।
শাসকের বিরোধীতায় নেমে বাঙালির মনে জাগল স্বজাত্যাভিমান ও স্বনির্ভরতার স্বপ্ন। এই প্রেক্ষাপটে নেতারা যোগ করলেন বিদেশি দ্রব্য বর্জন করে সম্পূর্ণ স্বদেশি হয়ে ওঠার ডাক। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ সবাইকে ধর্মমতের বিভেদ সরিয়ে সৌভ্রাত্বের ছায়ায় এনে দাঁড় করিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে একসূত্রে বেঁধে আন্দোলনকে আরও জোরদার করার কাজ শুরু করলেন।
১৬ অক্টোবর সে-বছরের বাংলা ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ছিল আশ্বিন মাসের ৩০ তারিখ। ঠাকুরবাড়ির স্বাদেশিকতা ও সৌভ্রাতৃত্ব-ভাবনার কান্ডারী তখন রবি ঠাকুর। তাঁর মাথায় এই সময় খেয়াল উঠল যে, সবাইকে এক করে তুলতে রাখি বন্ধন উৎসব করতে হবে এবং সেটি ওই বঙ্গভঙ্গের জন্য ঘোষিত বিশেষ দিনটিতেই।
'ঘরোয়া' বইটিতে সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে অবন ঠাকুর জানাচ্ছেন যে, "রবিকাকা বললেন রাখীবন্ধন-উৎসব করতে হবে আমাদের, সবার হাতে রাখী পরাতে হবে। উৎসবের মন্ত্র অনুষ্ঠান সব জোগাড় করতে হবে...ছিলেন ক্ষেত্রমোহন কথক ঠাকুর...তাঁকে গিয়ে ধরলুম, রাখি বন্ধনের একটা অনুষ্ঠান বাতলে দিতে হবে। তিনি খুব খুশি ও উৎসাহী হয়ে উঠলেন, বললেন, এ আমি পাঁজিতে তুলে দেব, পাঁজির লোকদের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে, এই রাখি বন্ধন উৎসব পাঁজিতে থেকে যাবে।"
সুতরাং, এই হল আমাদের বাংলায় রাখি বন্ধন উৎসবের প্রারম্ভিক ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথ যে উদ্যোগ ও উদ্দীপনার জন্ম দিলেন, তা স্বদেশি আন্দোলনের নেতাদের ব্যাপক উৎসাহী করে তুলল। তাঁরা তো উৎসবের দিনটি কীভাবে পালিত হবে তাই নিয়েই দারুণ একখানা ইস্তাহারই বের করে ফেললেন। সেখানে প্রস্তাব রাখলেন :
"৩০সে আশ্বিন তারিখে বঙ্গবাসীর দেহে নবজীবন সঞ্চারিত হইয়াছে। বাঙ্গালী মৃত্যুর মধ্যে অমৃতের সন্ধান পাইয়াছে। সেদিন-
১। সমস্ত বাঙ্গালী নরনারী, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, কাহারও রন্ধনশালায় অগ্নি জ্বলিবে না।
২। সকলে দুগ্ধ বা ফলাহার করিয়া অথবা সমস্ত দিন উপবাস করিয়া ভগবানে আত্মসমর্পণ করিবেন এবং যিনি রাজার উপরে রাজা, পতিত জাতির উদ্ধারকর্ত্তা, দেশের মঙ্গলের জন্য তাঁহার আশীর্ব্বাদ ভিক্ষা করিবেন।
৩। বঙ্গের প্রত্যেক গ্রামে ও নগরে হিন্দু, মুসলমান ও খৃষ্টান সকলে একত্র হইয়া মহাব্রত গ্রহণ করিবেন।
(ক) বিদেশী দ্রব্য বর্জ্জন। (খ) স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার। (গ) স্বদেশী দ্রব্য উৎপাদনে আপন শক্তি ও অর্থ নিয়োগ (যথা, কল কারখানা স্থাপন, গৃহে গৃহে চরকার প্রচলন ইত্যাদি।)
৪। সেদিন সমস্ত বঙ্গবাসী স্নানান্তে পরস্পরের হস্তে "রাখী-বন্ধন" করিবেন এবং চিরদিন সুখে দুঃখে পূর্ব্ব ও পশ্চিম বঙ্গবাসী সমুদয় হিন্দু, মুসলমান ও খৃষ্টান পরস্পরের সহায়তা করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইবেন।" (উদ্ধৃতি ও বানান - শ্রীমতিলাল রায়ের লেখা 'স্বদেশীযুগের স্মৃতি' প্রবন্ধ থেকে)।
প্রস্তাবগুলি সকলের কাছেই সাদরে গৃহীত হল। অবিলম্বেই ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেল রাখিবন্ধন উৎসবের প্রস্তুতি। রবি ঠাকুর লিখে ফেললেন উৎসবের মন্ত্রগান 'বাংলার মাটি, বাংলার জল'।
উৎসব শুরু হল আশ্বিনের ৩০ তারিখের সকালবেলা থেকেই। ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা দলবেঁধে গঙ্গায় চললেন স্নানে। জগন্নাথ ঘাটের দিকে। সঙ্গে নিলেন একগাদা রাখি। 'স্বদেশী ভাণ্ডারে' তৈরি। মনিব ও নিজেদের কাপড়-গামছা নিয়ে ঠাকুরবাড়ির চাকরেরাও চললেন সঙ্গে। এ-দিন মনিব ও চাকর একসঙ্গে একঘাটে স্নান করবেন।
ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা পথে নামতেই জমে উঠল বিশাল এক শোভাযাত্রা। জোড়াসাঁকো আর চিৎপুরের সাধারণ-অসাধারণ সব বাড়ির মেয়েপুরুষই সোৎসাহে নেমে পড়লেন রাস্তায়।
শোভাযাত্রাটি সুশৃঙ্খলভাবে যখন এগোতে শুরু করল, তখন দীনু ঠাকুর গান ধরলেন - 'বাংলার মাটি, বাংলার জল'। সবাই তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন। মেয়েরা ছড়াতে লাগলেন খই। তাঁদের উলু আর শঙ্খধ্বনিতে চারিদিকে মুহূর্তেই উৎসবের মেজাজ তৈরি হয়ে গেল।
জগন্নাথ ঘাটে স্নান করে রবি ঠাকুর ও তাঁর দলবল ফেরার সময় পথের ধারে যাকে পেলেন বর্ণধর্ম নির্বিশেষে সবার হাতেই রাখি বাঁধতে শুরু করলেন। ঘোড়ার খিদমত খাটতে থাকা সহিসেরাও বাদ গেল না। কবি তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন।
তারপর কবির ইচ্ছে হল চিৎপুরের বড় মসজিদের সবাইকে রাখি পরাবেন। সবাই তো ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়ে গেলেন, মুসলিমরা যদি মনে করে এতে তাদের ধর্মে আঘাত লাগছে! মসজিদে রাখি পরাতে গিয়ে যদি মারামারি কাণ্ড বাঁধে!
কিন্তু কবির যখন একবার খেয়াল চেপেছে, তাঁকে নিরস্ত করে কে! বেগতিক বুঝে অবন ঠাকুর সুট করে মিছিল থেকে কেটে পড়ে সটান জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে খবর দিলেন কবির খেয়ালের। আশঙ্কা প্রকাশ করলেন সম্ভাব্য ঝামেলার!
তখন সবাই এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন যে, দারোয়ান-টারোয়ান নিয়ে একদম ছুটলেন মসজিদের দিকে। কিন্তু, তাঁরা সেখানে পৌঁছে প্রথমে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
কারণ, তাঁরা দেখলেন দলাদলি-লাঠালাঠি কিচ্ছু নেই, মসজিদ থেকে ভারি খুশি হয়ে কবিরা বেরিয়ে আসছেন। শুনলেন, কবিরা মসজিদে মৌলবি থেকে শুরু করে সবার হাতে তাঁরা রাখি বেঁধেছেন, কোলাকুলি করেছেন, মসজিদের সকলেই এতে খুব উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন এবং মজা পেয়েছেন। তখন তাঁদেরও আনন্দের সীমা রইল না।
এভাবেই সে-দিন রবি ঠাকুরের হাত ধরে বাংলায় পরস্পরের হাতে রাখি বাঁধার আচার তৈরি হল। পালনের মধ্য দিয়ে আচারটিকে উৎসবের মর্যাদা দেওয়া হল। হাজার রকমের বিভেদ সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান এই উৎসবের মধ্য দিয়েই এক হল। সম্মিলিত আন্দোলনে সৌভ্রাতৃত্বের রঙ লাগল।
ফলত একসময় বঙ্গভঙ্গের বিভেদনীতি থেকে ইংরেজ শাসক সরে আসতে বাধ্য হল। ঐতিহ্যের ধারায় ইতিহাস ছুঁয়ে 'রাখি বন্ধন' সম্প্রীতির বন্ধন থেকে স্বদেশিযুগে এসে সম্প্রীতির উৎসবে পরিণত হল। গড়ে তুলল ঐতিহ্যের নতুন ধারা।
সেই ধারা বেয়েই রাখিবন্ধন উৎসবে সম্প্রীতির স্রোতটি আজও সমানভাবে আমাদের উদ্দাম ভাসিয়ে নিয়ে যায় সৌভ্রাতৃত্বের তীরে। ঈদ ও দুর্গাপুজোর মতোই এও যেন আমাদের মিলনের এক জাতীয়-উৎসব।