জীবনচর্যা ও ইতিহাসচর্চায় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

অদ্ভুতভাবে জন্মের পর-পরই সাত-সাতটি সন্তানের মৃত্যু হল; অনেকটা কপালগুণেই বেঁচে গেলেন অষ্টম-গর্ভের পুত্র-সন্তান।  তাই বোধহয় পুরাণের অষ্টম-গর্ভজাত ব্রজের রাখালটির কথা ভেবে, ছেলের নাম রাখা হল, 'রাখালদাস'। রাখাল হয়ে উঠলেন বাপমায়ের চোখের মণি। মানুষ হতে লাগলেন অতিরিক্ত আদরে। বাবা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বহরমপুর কোর্টের নামজাদা উকিল। দারুণ বড়লোক। তাছাড়া, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে পাওয়া পূর্বপুরুষের জমিদারি তো ছিলই। তাই নীল রক্ত রাখালের শরীরেও বইল।  ঠাটেবাটে-সাজসজ্জায়-আদবকায়দায়-মেজাজেমর্জিতে রাখাল হয়ে উঠলেন সেকেলে জমিদারের সার্থক উত্তরসূরি এবং নব্যবঙ্গের 'বাবু'। তাঁর বাবুয়ানির বেশকিছু গল্প আছে : 

কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে রাখাল যখন এফ এ পড়তে এলেন, তখন থেকেই তাঁর জন্য ব্যবস্থা করা হল একখানা দুই ঘোড়ার কোচগাড়ি। মনখানেক চালের দাম তখন এক টাকা, তবু অবলীলায় স্টেশনের কুলিকে ফি-বার দশ টাকা বখশিশ দিতে তাঁর বাধলো না। বন্ধুবান্ধদের ডেকে নিয়মিত এলাহী ভোজসভাও চলতে লাগল।  সেইসঙ্গে তাঁর জমিদারসুলভ মনটির দরজায় এসে কেউ সাহায্য চেয়ে দাঁড়ালো, অথচ না-পেয়ে ফিরে গেল--এমনটাও কখনো ঘটল না।

নাটোরের মহারাজার আমন্ত্রণে একবার রাজশাহী গেলেন রাখালদাস ও তাঁর কয়েকজন ইতিহাসবিদ বন্ধু। রাজবাড়িতে স্বভাবতই স্বাচ্ছন্দ্যের নিখুঁত আয়োজন রয়েছে। তবু সৌজন্যবশত অতিথিবন্ধুদের কোনরকম অসুবিধে হচ্ছে কি না, তার খোঁজ নিতে এলেন স্বয়ং মহারাজ। সবাই যখন নিখুঁত ব্যবস্থাপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, মহারাজও যখন আহ্লাদে আটখানা; ঠিক তখনই রাখালদাস মুখের ওপর বলে দিলেন যে, সবই ঠিক আছে, তবু তাঁর একটু অসুবিধে হচ্ছে! মহারাজ অমনি শশব্যস্ত, কি অসুবিধে! রাখালদাস বলে চলেন, এই যে তাঁর অনভ্যাসের কোঁচটি মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে, কিছুতেই বাগিয়ে রাখতে পারছেন না; তা সেটা সামলানোর জন্য একটা চাকর-বাকর কাউকে লাগে, হাঁকডাক করা সত্ত্বেও কই তেমন তো কেউ এগিয়ে আসছে না! এটা সমস্যা নয়? মহারাজ বুঝলেন, রাখালবাবু শুধু বাবু নন, রীতিমতো বাবু!

অথচ এই বাবু মানুষটিরই চরম কৃচ্ছ্সাধনার পরিচয় মেলে তাঁর ইতিহাস-অনুসন্ধান পর্বে। তিনি তখন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট, কাজ করছেন পুণের অফিসে। সিন্ধু-শতদ্রুর তীরে সম্রাট আলেকজান্ডার গ্রিক ও ভারতীয়-লিপি সম্বলিত যে বারোটি শিলামঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন, সেগুলো খুঁজে বার করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি একদিন সদলবলে পাড়ি দিলেন সিন্ধু প্রদেশে। সিন্ধুর মজা খাত ধরে দক্ষিণ পাঞ্জাব, বিকানীর, বাহাওয়ালপুর পেরিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে করতে শেষমেশ সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলায় হাজির হলেন। এরইমধ্যে কাজের অবসরে একদিন সিন্ধু উপত্যকার এক জঙ্গলে গেলেন শিকার করতে। প্রায় গল্পের মতোই হরিণের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেললেন তিনি। তারপর হাজির হলেন যেখানে, সেটাই মহেঞ্জোদাড়ো। আর এখানেই  হঠাৎ চোখে পড়ল বেলেমাটিতে পড়ে থাকা একটা ছুরি। হাতে তুলে বুঝলেন, ছুরিটা বেশ প্রাচীন চকমকি পাথরের তৈরি। অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে বুঝতে পারলেন, এই অঞ্চলের মাটির নীচেই লুকিয়ে আছে আরও প্রাচীনতম চমক। তারই সন্ধানে শুরু হল খনন। শুরু হল সিন্ধু সভ্যতাকে মাটি ভেতর থেকে তুলে আনার সাধনা। সেটা ১৯২২ সাল।

ক্যাম্প পড়ল। আবহাওয়া অসম্ভব শুকনো। দিনে অসহ্য গরম, রাতে দারুণ ঠাণ্ডা। সেই ঠাণ্ডায় জল জমাট বেঁধে যায়। শহরের সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগাযোগ তেমন নেই। তাই, খাবার ও জলের যোগান অনিয়মিত। এই নিদারুণ পরিস্থিতিতেও অন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাবু রাখালদাস দিনের পর দিন স্বল্প জল খেয়ে, অন্য খাবারের বদলে নিছক উটের মাংস খেয়ে দিনের পর দিন কাজ করে যেতে লাগলেন। কিন্তু, ক্যাম্পের এই কঠোর জীবন একসময় রাখাল আর সহ্য করতে পারলেন না, অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে ফিরে এলেন পুণেতে। তাঁর ফেরার জন্যই চরম একটা দুর্ঘটনা যেন অপেক্ষা করে ছিল। হঠাৎ মারা গেল তাঁর বড় ছেলে অসীম। মাত্র পনেরো বছর বয়সে। আকস্মিক এই নিষ্ঠুর আঘাতে একেবারে ভেঙে পড়লেন রাখাল। শরীর-মনের এই ধাক্কা কোনরকমে সামলালেন বটে, কিন্তু ভেতরের ক্ষতটা সারলো না। কাজে ফিরতে গড়িয়ে গেল একটা বছর। 

১৯২৬ সাল। ইতিহাসের নতুন নতুন তথ্য ও সত্য আবিষ্কারের জন্য সার্ভে এবং খননের কাজ তাঁর নেতৃত্বে যখন চলছে, তখনই তিনি হলেন এক দারুণ ষড়যন্ত্রের শিকার। মধ্যপ্রদেশের চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের পুরোহিত হঠাৎ অভিযোগ জানালেন যে, রাখালদাস নাকি একটি মূর্তি চুরি করেছেন! অভিযোগটির সত্যতা যদিও প্রমাণিত হল না, তবুও রাখালদাসকে সেটা স্তম্ভিত ও বিধ্বস্ত করে ছাড়ল। এতবড় অপমান জীবনে কোনোদিন তাঁর হয়নি। এই অপমানের মধ্যে, হোক না মিথ্যে, তবু সে দায় নিয়ে কাজ করা যায় না। তিনি পদত্যাগ করলেন। 

শুরু হল পুরোদস্তুর বেকার-জীবন। ইতিমধ্যে অনেক জল গড়িয়েছে। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে নানান ঝামেলায় সবই প্রায় বেহাত হয়ে গেছে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাতে তাঁর ঠাটবাট বজায় রাখা অসম্ভব। এইসময় বন্ধু রামপ্রসাদ চন্দ'র সাহায্যে বছর দুয়েক ধরে ময়ূরভঞ্জের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় উড়িষ্যার ইতিহাস লেখার কাজ জুটল। লিখলেন। তারপর ১৯২৮-এ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হিসেবে যোগ দিলেন। কিন্তু, কোন কিছুতেই তাঁর আর আগের মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা এলো না। পুত্রশোক, সম্মানহানি, আর্থিক দুশ্চিন্তা মানসিক দিক দিয়ে বিক্ষত তো করেই চলেছিল; এর-সঙ্গে ক্রনিক ডায়াবেটিসও এবার তাঁকে কাবু করে ফেলল। এই রোগেই ১৯৩০-এর ২৩ মে, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হল। একইসঙ্গে বাবু এবং কর্মযোগী রাখালদাস একাধারে সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক।   বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে তিরিশখানা বই এবং আড়াইশোর বেশি প্রবন্ধ লিখে তিনি যেমন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন; তেমনি ইতিহাস চর্চায় রেখেছেন অমূল্য অবদান।

তথ্যঋণ: প্রাগৈতিহাসিক মোহেন-জো-দড়ো--শ্রীকুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী

Rakhaldas Bandyopadhyay--Asok K. Bhattacharya

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...