সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা এই তিনখানা গ্রাম নিয়ে নগর কলিকাতা গড়ে ওঠার বহু আগে থেকেই গোবিন্দপুরে ছিল রাজনারায়ণ বসুর পূর্বপুরুষের বাস। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি নগরের হত্তাকত্তা হয়ে গোবিন্দপুরের সেই বসুভিটেতেই কেল্লা ফাঁদবার ফিকির করল। বদলি জমি দিল সিমলায়। সেখানে কয়েক বছর বাস করেও প্রপিতামহ শুকদেব বসুর পোষাল না। তিনি কলিকাতার বাস উঠিয়ে কয়েক মাইল দূরের বোড়াল গ্রামে এসে ভিটের পত্তন করলেন। এখানেই ১৮২৬-এর ১৭ সেপ্টেম্বর রাজনারায়ণ বসুর জন্ম হল।
রাজনারায়ণ হেয়ার স্কুল ও হিন্দু কলেজের ছাত্র। ডেভিড হেয়ার, ডি এল রিচার্ডসন, রিজ সাহেবের মতো মুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার শিক্ষকদের গুরু হিসেবে পেলেন। সহপাঠী হিসেবে পেলেন মধুসূদন দত্ত, প্যারীচরণ সরকার, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের মতো পরবর্তীকালের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল, তাঁর টানে যোগ দিলেন ব্রাহ্মসমাজে। সব মিলিয়ে রাজনারায়ণ মননে প্রগতিশীল ও সংস্কারপন্থী হয়ে উঠলেন এবং নতুন কিছুকে গ্রহণ করার মতো ঔদার্য অর্জন করলেন।
উনিশ শতকের পাঁচের দশকে রাজনারায়ণের দীর্ঘ সংস্কারকর্মের সাক্ষী হল মেদিনীপুর। ১৮৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মেদিনীপুর জেলা স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে এলেন। এসেই স্কুলের পড়াশুনোর উন্নতি ঘটাতে একেবারে যাকে বলে উঠে-পড়ে লাগলেন। মারধর করে শিক্ষার ঐতিহ্যটি স্কুল থেকে ধীরে ধীরে তুলে দিলেন।
কয়েক বছর আগে শিবচন্দ্র দেব নামে এক ভদ্রলোক মেদিনীপুর শহরে প্রথম ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেছিলেন। সেটি একদা উঠেও গিয়েছিল। রাজনারায়ণ সেটির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রচার শুরু করলেন। সেইসঙ্গে স্থাপন করলেন, 'সুরাপান নিবারণী সভা'। ফলে, একে একে ধান্দাবাজ, অসহিষ্ণু হিন্দু, বঞ্চিত মাতাল--সবার শত্রু হয়ে উঠলেন। তার মধ্যেই এলো ১৮৫৬ সাল। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ বিষয়ক আন্দোলন কলিকাতায় যে ঢেউ তুলল, তার প্রবাহ তাঁর জন্মভূমি মেদিনীপুরে গিয়েও উত্তাল করল। অধিকাংশ পাশ্চাত্যশিক্ষিত বাঙালি তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের সপক্ষ লেখায় যে যুক্তি, যে বাস্তবতা, যে মুক্ত চিন্তা তা রাজনারায়ণের হৃদয় ছুঁলো। মেদিনীপুরের মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে তিনি এই সংস্কার আন্দোলন বয়ে আনলেন বোড়ালেও।
বিধবা বিবাহ আইনে পরিণত হলে প্রথম বিবাহ করলেন কলিকাতার শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে। দ্বিতীয়টি করলেন পানিহাটির মধুসূদন ঘোষ। তৃতীয় ও চতুর্থ বিবাহদানের কৃতিত্বটি কিন্তু রাজনারায়ণ বসুর। পাত্র যথাক্রমে, জেঠতুতো ভাই দুর্গানারায়ণ বসু ও আপনভাই মদনমোহন বসু। রাজনারায়ণ বিবাহিত, নইলে বিধবা-বিবাহ করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের ক্ষেত্রে তিনিই হয়তো প্রথম হতেন। তবে ভাইদের বিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত রাখলেন--ঘর বাঁচিয়ে নয়, সংস্কার শুরু করতে হয় বাড়ি থেকেই। বিয়ের আগে রাজনারায়ণের মা গিয়েছিলেন তীর্থ করতে মথুরায়। ফিরলেন বিয়ের পরে। সব শুনে রাজনারায়ণের ওপর দারুণ ক্ষেপে গেলেন। গালমন্দ, তিরস্কারের বাকি রাখলেন না; শুধু সম্পর্কচ্ছেদ করতে বাকি রাখলেন। কাকা তেমন আস্ফালন করলেন না, কিন্তু দোষ দিতে ছাড়লেন না 'তোমার দ্বারা আমরা কায়স্থকুল হইতে বহিষ্কৃত হইলাম।' এ তো গেল বাড়ির অবস্থা। গ্রামের অবস্থা হল আরও ভয়ানক। তাদের বিশ্বাস গ্রামের সুস্থ সমাজ ও ধর্মকে রাজনারায়ণ গোল্লায় পাঠাবার চক্রান্ত করছেন! তাই তারা সরাসরি হুমকি দিল: 'রাজনারায়ণ বসু গ্রামে আইলে আমরা ইট মারিব।' রাজনারায়ণ অবশ্য যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন: 'তাহা হইলে আমি খুসী হইব, আমি বাঙ্গালীকে উদাসীন জাত বলিয়া জানি!'
মেদিনীপুরেও শুরু হল চরম বিরুদ্ধতা। সরকারি উকিল হরনারায়ণ দত্ত রাজনারায়ণের বিরুদ্ধে লোক ক্ষেপাতে লাগলেন। ঘুরিয়ে হুমকি দিলেন হত্যার : 'রাজনারায়ণ বাবু জানেন না যে তিনি বাঙ্গালা ঘরে বাস করেন!' অর্থাৎ রাজনারায়ণ এমন ঘরে থাকেন, যাতে আগুন দিয়ে উকিলবাবু ইচ্ছে করলেই যেকোন সময় তাঁকে পুড়িয়ে মারতে পারেন!
স্ত্রীকন্যা নিয়ে সংসারী মানুষ রাজনারায়ণ। তিনি কি এসব হুমকিতে হয় পাননি? পেয়েছিলেন নিশ্চয়। তাই হয়তো আত্মরক্ষার জন্য জঙ্গল থেকে মোটা লাঠি কেটে এনেছিলেন। বিপুল সংখ্যক বিরুদ্ধ-মানুষের বিপক্ষে একটা লাঠি নিয়ে আত্মরক্ষার ভাবনা, হয়তো নেহাতই ছেলেমানুষি। কিন্তু, এই ছেলেমানুষিই বুঝিয়ে দেয় মানুষটা কাপুরুষ নন। যাই হোক না কেন তিনি তাঁর সংকল্প থেকে সরে আসেননি। যা ভেবেছেন, করে দেখিয়েছেন। মহত্ব এখানেই। ভেতরে ও বাইরের বিরুদ্ধতা মানুষটাকে উদ্বিগ্ন করেছে, কিন্তু বিভ্রান্ত করতে পারেনি। বন্ধু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ-সময় পশ্চিমে ছিলেন। সশরীরে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াতে না-পারলেও সেখান থেকেই বন্ধুর উদ্বিগ্ন মনে শান্তির পরশ দিয়ে লিখলেন, 'সাধু যাহার ইচ্ছা ঈশ্বর তাহার সহায়।'
ধীরে ধীরে সমাজের 'গেল গেল' আর্তনাদ স্তিমিত হল। বিরুদ্ধতা অন্যখাতে বইতে লাগল। কিন্তু, বন্ধুর বাণীটি রাজনারায়ণের জীবনের অবলম্বন হয়ে রয়ে গেল, 'সাধু যাহার ইচ্ছা ঈশ্বর তাহার সহায়।'
তথ্যঋণ: 'আত্মচরিত' - রাজনারায়ণ বসু এবং 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' - শিবনাথ শাস্ত্রী।