বাংলার নবজাগরণের অনন্য কান্ডারী রাজেন্দ্রলাল মিত্র

আজ এক নক্ষত্রের কথা বলব আপনাদের। আকাশে অজস্র নক্ষত্র থাকে, কিন্তু কটার নাম আমরা জানি? বাঙালিকে লোক অতীত বিলাসী জাতি হিসেবেই চেনে। আদপে কি তাই? বাঙালি কিছু জিনিসকে মনে রাখে আর কিছু জিনিসকে সে সচেতনভাবে, সযত্নে ভুলে যায়। তেমনই এক ভুলে যাওয়া নাম হল রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের প্রথম সারির ছাত্র। কিন্তু বাঙালিকে কি কারও অধীনে কোনদিন রাখা গিয়েছে নাকি? সাহেব কর্তৃপক্ষের আস্ফালন রাজেন্দ্রলাল বরদাস্ত করেননি। ইতি টানলেন ডাক্তারি পড়ায়, আইন পড়তে শুরু করেন। তাও ভাল লাগলো না। কালো কোট বা সাদা অ্যাপ্রন নয়! ভাষানুশীলনে ব্রতী হয়েছিলেন রাজেন্দ্রলাল।

এ দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতির অন্যতম পথিকৃৎ রাজেন্দ্রলাল মিত্র। বাংলার নবজাগরণের অনন্য পথিকৃৎ তিনি। এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের সদস্য ছিলেন। ১৮৪৬ সালে রাজেন্দ্রলাল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের গ্রন্থাগারিক হন। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সভাপতিও ছিলেন তিনি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "যে-এশিয়াটিক সোসাইটিতে রাজেন্দ্রলাল এক সময়ে সামান্য বেতনে কর্ম্মজীবন সুরু করেন, অক্লান্ত পরিশ্রম ও যোগ্যতাবলে কালক্রমে সেই বিদ্বৎসভার সভাপতির পদ পর্যন্ত অধিকার করিয়াছিলেন, তাঁহার পূর্ব্বে আর কোন বাঙালীই এই উচ্চ সম্মানের অধিকারী হন নাই।''

রাজেন্দ্রলাল মিত্রই ছিলেন প্রকৃত অর্থে প্রথম আধুনিক ভারততত্ত্ববিদ। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভারতীয় ভাষাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব এবং রূপতত্ত্ব বিষয়ে গভীরভাবে গবেষণা করেন। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও রাজেন্দ্রলাল মিত্রকে নিয়ে আক্ষেপের সুর পাওয়া যায়, "তখন যে বাংলা সাহিত্য সভার প্রতিষ্ঠা চেষ্টা হইয়াছিল সেই সভায় আর কোনো সভ্যের কিছুমাত্র মুখাপেক্ষা না করিয়া যদি একমাত্র মিত্র মহাশয়কে দিয়া কাজ করাইয়া লওয়া যাইত, তবে বর্তমান সাহিত্য-পরিষদের অনেক কাজ কেবল সেই একজন ব্যক্তি দ্বারা অনেকদূর অগ্রসর হইত সন্দেহ নাই।"

রাজেন্দ্রলাল মিত্রের দিনলিপি থেকে জানা যায়, ১৮২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব কলকাতার শুঁড়ায় সম্ভ্রান্ত কুলীন কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তৎকালীন এই শুঁড়া অঞ্চলই আজ বেলেঘাটা নামে পরিচিত। রাজেন্দ্রলালের বাবা জনমেজয় মিত্র সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। বাংলা ভাষাতেও তিনি বহু বই লিখে গিয়েছেন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি রসায়ন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর ছয় পুত্রের মধ্যে তৃতীয় পুত্র ছিলেন রাজেন্দ্রলাল। রাজেন্দ্রলালের এক বোনও ছিল। জনমেজয় ছয় পুত্র আর এক কন্যাকে লালন-পালন করতে সমর্থ ছিলেন না। বিধবা ও নিঃসন্তান পিসিমার কাছেই মানুষ হন রাজেন্দ্রলাল মিত্র।

মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কালিদাস মিত্র। কালিদাসের অষ্টাদশ বংশধর রামচন্দ্র মিত্র ছিলেন মুর্শিদাবাদের দেওয়ান। পরবর্তীতে তিনি রামচন্দ্রের পুত্র অযোধ্যারাম ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে 'রায়বাহাদুর' উপাধি লাভ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের প্রপিতামহ পীতাম্বর মিত্র অযোধ্যা ও দিল্লির রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। তারাও 'রাজাবাহাদুর' উপাধি লাভ করেছিলেন। রাজেন্দ্রলালের প্রপিতামহ বিপুল অর্থসম্পদের অধিকারী হলেও, ঠাকুরদা বৃন্দাবন মিত্রের ভোগবিলাস এবং ব্যয় বাহুল্যের জন্য সেই অর্থসম্পদ অচিরেই শেষ হয় গিয়েছিল। রাজেন্দ্রলালের বাবা জনমেজয় বাঁধা বেতনে চাকরি করতে চাননি কখনও, তাই শৈশবে এক প্রকার দারিদ্র্যের মধ্যেই বড় হয়েছেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ১৮৩৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে কলকাতার নিমতলা নিবাসী ধর্মদাস দত্তের তৃতীয় কন্যা শ্রীমতি সৌদামিনীকে বিবাহ করেন তিনি। তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা ছিল। ১৮৪৪ সালের ২২ আগস্ট প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলে ১৮৬০-৬১ সাল নাগাদ ৩৮ বছর বয়সে ভবানীপুরের কালীধন সরকারের কন্যা ভুবনমোহিনীর সঙ্গে রাজেন্দ্রলালের পুনর্বিবাহ হয়। ভুবনমোহিনী এবং রাজেন্দ্রলালের দুই পুত্র যথাক্রমে রমেন্দ্রলাল এবং মহেন্দ্রলাল। 

এ তো ছিল ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু বৃহত্তর সমাজের জন্য কী করলেন তিনি? ভূগোলের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসকে চেনানো, এই ভাবনার বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগ ঘটানোই রাজেন্দ্র লালের কৃতিত্ব। নিজ সম্পাদিত 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় রাজপুত জাতির ইতিবৃত্ত লিখে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছেন তিনি। সম্ভবত সেটিই ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র পত্রিকা, এখানেও অভিনব ভাবনায় বিপ্লব ঘটালেন রাজেন্দ্রলাল। এক মুসলমান চিত্রশিল্পীকে দিয়ে আঁকিয়ে নিলেন রাজপুতানার মানচিত্র। আরও পরে অবশ্য বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় সমগ্র ভারতের মানচিত্রও তৈরি করেন। এই কাজে তাঁর সুখ্যাতি ও পারদর্শিতা কালে কালে বৃদ্ধি পেল, সরকারি আমন্ত্রণে উত্তর-পশ্চিম ভারতের ম্যাপও তৈরি করে দিয়েছিলেন রাজেন্দ্রলাল। ১৮৫৪ সালে মুদ্রিত রাজেন্দ্রলালের 'প্রাকৃত ভূগোল' বইয়ে তিনি সে কালের পক্ষে নতুন এই বিষয়ে আগ্রহী পড়ুয়াকে জানাচ্ছেন: "ভূগোলের যে অংশে... পৃথিবীর প্রকৃতাবস্থার বিবরণ বিষয়ক আলোচনা থাকে, তাহার নাম প্রাকৃত ভূগোল।" অল্পবয়সি শিশুদের হাতে ভূগোল বই দেওয়া হয় বলে মিত্রমশাই বাংলা ভাষায় ভূগোলচর্চা বিষয়ে নানাবিধ পরিকল্পনায় ব্রতী হয়েছিলেন, তার বহু নিদর্শন আজও লক্ষিত।

শুধু ভূগোল নয়, বহুবিদ্যা-বিশারদ পণ্ডিত 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' ছাড়া 'রহস্য সন্দর্ভ' নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। এই দু'টি সাময়িকীতে গ্রন্থাগার, আগ্নেয়গিরি, মিশরের পিরামিড, বৌদ্ধদের মঠ থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক, ভূতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, অ্যাজটেকদের নরবলি ইত্যাদি বহুবিধ বিচিত্র বিষয়ে নিজে লিখেছেন, অন্যদের দিয়ে লিখিয়েছেন। মনেপ্রাণে চাইতেন সাধারণ মানুষ যেন অনায়াসে বিদ্যালাভ করতে পারে, বালক-বালিকাদের যেন সহজে খেলার ছলে জগতের নানা বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ধারণা তৈরি হয়।

রাজেন্দ্রলালের যে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ছিল, তা রহস্য পত্রিকার নামকরণে স্পষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যাকে আত্মস্থ করে ভারতবিদ্যার অসীম রহস্য অনুসন্ধানে তিনি যাত্রা করেছিলেন। এ কাজে তাঁর সঙ্গী হয়ে উঠেছিল 'এশিয়াটিক সোসাইটি'। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর সম্পাদনায় ১৩টি সংস্কৃত এবং ২১টি ইংরেজি বই প্রকাশিত হয়েছে, সোসাইটির জার্নালে লিখেছেন অজস্র প্রবন্ধ। চার খণ্ডে রচিত 'পত্রকৌমুদী' বইটির মাধ্যমে বাঙালিকে চিঠি লেখাও শিখিয়েছেন রাজেন্দ্রলাল।  গুরুজন, স্নেহভাজনকে পত্র, পাট্টা-কবুলিয়ৎ প্রভৃতি স্বত্ব এবং আদালতে প্রযোজ্য আইনি পত্র প্রভৃতির লিখনপদ্ধতি সহজ ভাষায় লিখতে শিখিয়েছেন। এমন অতিমানবীয় প্রতিভা বাংলায় বিরল নয় ঠিকই কিন্তু হাল আমলে এমন মেধার যে অবলুপ্ত। বিদেশি শিক্ষাকে গ্রহণ করে, ভারতীয় সমাজে তার প্রয়োগ ঘটিয়ে স্বদেশের যে উপকার নীতি করে গিয়েছেন তার সুফল আজও বাংলা পেয়ে চলেছে, তাই তো এই মহামানবের কাছে বাংলা চিরঋণী হয়ে থাকবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...