কেউ বলে রাজা কেউ বা জমিদার। উত্তরপাড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবার। মূলত পাঁচ ভাইয়ের বৃত্তান্ত। জয়কৃষ্ণ, রাজকৃষ্ণ, নবকৃষ্ণ, বিজয়কৃষ্ণ ও নবীনকৃষ্ণ। উত্তরপাড়ার মুখোপাধ্যায় বাড়ি প্রথমদিকে কিন্তু জমিদার বাড়ি হিসেবেই পরিচিত ছিল। জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় এবং রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র হরিহর মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্র জ্যোৎকুমার মুখোপাধ্যায় পরবর্তীতে রাজা উপাধি পেয়েছিলেন ব্রিটিশদের থেকে। প্রথমদিকে এই পরিবারের মূল বাড়ি ছিল তাঁদের ঠাকুমা শিবানী দেবীর বাড়ী। পাঁচ ভাইরা থাকতেন একসঙ্গে তখন। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলায়। পরিবার বাড়তে থাকে। ফলে বাসস্থানের সমস্যা তৈরী হয়।
১৮১০ খ্রিস্টাব্দে শিবানী দেবীর পুত্র জগমোহন এই বাড়ির পশ্চিমে আরেকটি বাড়ি গড়ে তোলেন। বাড়িটি তখন ছিল দোমহলা। পরবর্তীকালে জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এটিকে তিন মহলা বাড়িতে রূপান্তরিত করেন। এই জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালে আরেকটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর নির্মিত বাড়িটি উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হসপিটাল।
উত্তরপাড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও আরো বাড়ি তৈরি করেছিলেন। মোট সতেরোটি বাড়ি ছিল উত্তর পাড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবারের। প্রত্যেকটি বাড়ি প্রাসাদ সমান ছিল। কিন্তু বর্তমানে মোট সাতটি বাড়ি সংস্কারযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। তবে আশার কথা এরমধ্যে ছ'টি বাড়িই সরকার অধিগ্রহণ করেছে। একটি বাড়ি রূপান্তরিত হয়েছে হাসপাতাল হিসেবে। এই হাসপাতালের বিপরীত দিকে রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন রাজেন্দ্র ভবন। বর্তমানে এটি ডাক্তারদের আবাসস্থল।
উত্তরপাড়া মুখোপাধ্যায় পরিবারের বাকি রাজবাড়ীগুলিও মানুষের পরিষেবার জন্য ব্যবহার হয় এখন। যেমন একটি বাড়ি বর্তমানে অনাথআশ্রম। অন্যটি মানসিক রোগীদের জন্য আবাসস্থল। আরেকটি বাড়ি কোঅপারেটিভ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়াও রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে কাশীশ্বর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িটি এখন তাঁতকল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের একমাত্র সদস্য প্রতাপ নারায়ন মুখোপাধ্যায়ের বাড়িটির এখনো পর্যন্ত ব্যক্তিগত মালিকানা রয়েছে।
এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের বৈভবের ইতিহাস ব্রিটিশদের সঙ্গে যুক্ত। জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বাবা জগমোহন ছিলেন ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় শিক্ষিত পন্ডিত মানুষ। তিনি তাঁর মায়ের দাদা শ্রী রামহরি রায়চৌধুরীর সহায়তায় ব্রিটিশ কমিশনের অফিসে কোষাধ্যক্ষ পদে চাকরি পান। তিনি ছিলেন কর্মঠ, দক্ষ মানুষ। কর্মদক্ষতার জন্যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সুনজরে এসেছিলেন। পুরনো চাকরিতে যোগদান করার তিন বছর পরেই অর্থাৎ ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সেনার চতুর্দশ পদাতিক বাহিনীতে মেস ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানেও যথারীতি ছাপ রেখেছিলেন নিজের কর্মদক্ষতার।
১৮২৬ সালে ভরতপুর যুদ্ধ জয়ের পর ইংরেজ সরকার সেনাবাহিনীর প্রত্যেককে অনেক অর্থ পুরস্কার হিসেবে প্রদান করেছিলেন। জগমোহন মুখোপাধ্যায়ও পেয়েছিলেন এই উপহার। এরপর জগমোহন মুখোপাধ্যায় হুগলি জেলার বিভিন্ন অংশে অনেক একর জমি কেনেন। সেখানেই ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন প্রাসাদ। ধীরে ধীরে এই পরিবার নানা উল্লেখযোগ্য কাজ করতে থাকে উত্তরপাড়া অঞ্চলে।
তবে এই রাজ পরিবারের সকলেই ছিলেন প্রজাবৎসল। এই প্রসঙ্গে জগমোহন মুখোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি মোট ৩৫টি স্কুল নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রন্থাগার সবকিছুই নিজের উদ্যোগে তৈরি করিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজ সরকারের কাছে যে বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন করার জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন তাতে প্রথম স্বাক্ষর ছিল জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের। উদারপন্থী মানুষ তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। উত্তরপাড়ায় নারী শিক্ষার প্রসার তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয়।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার এবং আলিপুর চিড়িয়াখানার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মারফত বহু বিপ্লবীকে গোপনে অর্থ যোগান দিতেন তিনি। প্রচারবিমুখ, সাধক এই মানুষটি স্রোতের বিপ্রতীপে সাধনা করে গেছেন নিজের কাজের।
উত্তরপাড়ার মুখোপাধ্যায় পরিবার ধারাবাহিকভাবে বাংলার মানুষের শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন। জগমোহন-এর চতুর্থ পুত্র বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় হাওড়া , হুগলি জেলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু প্রতিষ্ঠা করেই থেমে যাননি তিনি। ওই অঞ্চলের সব মেয়েদের পড়তে আসার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সময়ও যেখানে বেথুন স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১০৫জন সেখানে উত্তর পাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা ছিল ১০৯জন।
বর্তমানে এই রাজবাড়ি দেখার জন্য যাওয়া যায়। তবে সে নিছকই ভ্রমণবিলাস। ইতিহাসের গন্ধমাখা এই পরিবারের স্মৃতি মূলত বয়ে চলে তাঁদের বিশেষ কীর্তিকলাপে যা উত্তরপাড়ার বুকে উন্নতির শিখা হয়ে জ্বলজ্বল করছে।