বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও শহর। এই শহর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে রানীশংকৈল উপজেলা। এই উপজেলার পূর্ব দিকে কুলিক নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি রাজবাড়ি। মালদুয়ার এই রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যময় অতীত। তবে বর্তমানে চরাচর জুড়ে শুধুই লাল ধুলোমাটি, ধ্বংসস্তূপ। আগাছায় ভরা। তবুও অতীত ঝিলিক দিচ্ছে স্মৃতির ডানায় ভর করে। মালদুয়া রাজবাড়ির লাগোয়া একটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরটি সংস্কারের অভাবে ভগ্নপ্রায়।
রাজবাড়ির বয়স ১০৩ বছর। পরিত্যক্ত এই রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অতীতের গৌরবময় ইতিহাস। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও শহরে অবস্থিত এই রাজবাড়ি।
ইতিহাসের পাতায় তেমনভাবে এই রাজবাড়ির কথা পাওয়া যায় না। শোনা যায়, এই রাজবাড়ির সঙ্গে যোগ ছিল ঘোষ বংশের এক নিঃসন্তান জমিদারের। তখনও রাজবাড়ি হয়ে ওঠেনি এটি। পারতপক্ষে জমিদারবাড়ি ছিল। ঘোষ বংশের এই জমিদার ছিলেন নিঃসন্তান। পরিবারের লোকজন বা আত্মীয়-স্বজন সেভাবে ছিল না। তবে প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন তিনি। প্রজাদের সন্তানের মত করে আগলে রাখতেন।
নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বে তাঁর সঙ্গী বলতে ছিল এই জমিদারবাড়ির লাগোয়া মন্দিরের সেবায়েত এক মৈথিলী ব্রাক্ষণ বুদ্ধিনাথ। জমিদার তীর্থে যাওয়ার সময় তাঁর জমিদারির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন সেই সেবায়েত বুদ্ধিনাথকে। শুধু তাই নয় একটি দলিল করেও দিয়ে যান তিনি যেখানে বলা ছিল তিনি কাশী থেকে না ফিরলে সেবায়েত বুদ্ধিনাথ এই জমিদারির মালিক হবেন। যথারীতি আর ফেরেননি এই জমিদার।
বুদ্ধিনাথ পেয়ে যান জমিদারি।
রাজা টংকনাথের এই রাজবাড়ি নিয়ে আরও একটি তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক বলেন এই ঘটনাটি আসলে টংকনাথের দু-এক পুরুষ আগের ঘটনা। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এই মালদুয়ার নাম ছিল রামগঞ্জ। সে সময় এই অঞ্চলের জমিদারি ছিল দুই বোনের হাতে। এই দুই বোন ছিলেন চিরকুমারী। তাঁরা পরিচিত ছিলেন বড় রানী ও ছোট রানী হিসেবে। উভয় রানী কাশীধামে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা একটি তামার পাতে জমিদারি বুদ্ধিনাথের নামে লিখে দিয়ে যান। এই দুই রানী আর ফেরেননি জমিদারি রক্ষা করতে। জমিদারি চলে যায় বুদ্ধিনাথের হাতে।
একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা শুরু করেছিলেন বুদ্ধিনাথ। কিন্তু তিনি সেটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাঁর তিন ছেলে ছিল। রামনাথ, টংকনাথ ও গৌরাঙ্গনাথ। রামনাথের অকাল মৃত্যু হয়। গৌরাঙ্গনাথ সেভাবে জমিদারির প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। ঐতিহাসিকরা বলেন গৌরাঙ্গনাথের সেই বুদ্ধি বা ক্ষমতা ছিল না জমিদারি পরিচালনা করার। টংকনাথ ছিলেন বুদ্ধিমান। বাবা বুদ্ধিনাথের মৃত্যু হলে তিনি সমস্ত জমিদারির মালিক হয়ে যান।
সময়টা ঊনিশ শতকের শেষের দিকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাজা টংকনাথ বাবার তৈরি ভবনটি নির্মাণ শেষ করেন। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে টংকনাথের সম্পর্ক ভাল ছিল। ব্রিটিশ সরকারের থেকে টংকনাথ রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। সেই থেকে এটি টংকনাথের রাজবাড়ি হিসেবেই পরিচিত হয়।
এই জনপদটি একসময় মালদুয়া পরগণার অন্তর্গত ছিল। পরে টংকনাথ ব্রিটিশ সরকারের আস্থাভাজন কর্মচারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। টংকনাথের উদ্যোগেই মালদুয়া স্টেট গঠন করা হয়। সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এরপরই টংকনাথ রাজা উপাধি পেয়েছিলেন।
পরে দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজা নাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে টংকনাথ নিজের রাজত্ব চালিয়েছিলেন দীর্ঘদিন। তবে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হলে টংকনাথ সপরিবারে ভারতে চলে যান। তাঁর পরিবারের কেউই এই রাজবাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কখনই আগ্রহ দেখাননি।
মূলত পরিত্যক্ত অবস্থাতেই এখনও পড়ে রয়েছে এই রাজবাড়ি। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ সহ্য করে এই রাজবাড়ি এখন ধ্বংসের পথে। ঐতিহ্যও মলিন হয়েছে। তবে সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে রাজবাড়িটি সংস্কারের চেষ্টা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও অনেকেই এই অঞ্চলে আসেন রাজবাড়ি দেখতে। প্রশাসনের তরফে চেষ্টা করা হচ্ছে মূল রাজবাড়ি সংস্কারের। সকলের প্রচেষ্টা আর শুভ কামনায় স্মৃতি, অতীত ঝড়, বৃষ্টি, রোদের মতোই হয়তো একদিন ঝিলিক দেবে রাজবাড়ি জুড়ে।