রাজবাড়ী পর্ব ১ঃ শ্রীরামপুর রাজবাড়ি

১৭৫৫ সাল। বাংলার নবাব তখন আলীবর্দী খাঁ। ড্যানিশ বা দিনেমাররা শ্রীরামপুর অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। বিদেশীরা তখন গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করছে আমাদের দেশে। লক্ষ্য বাণিজ্যের বিস্তার। দিনেমারদের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যের প্রসার। প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার সিক্কার বিনিময়ে তারা শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন-এর অনুমতি পায়। তখন শ্রীরামপুরের নাম বদলে রাখা হয় ফ্রেডেরিকনগর।

১৭৫৫ থেকে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত দিনেমাররা শ্রীরামপুরে ছিল। তারপর শ্রীরামপুর চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। দিনেমাররা বাণিজ্যের লক্ষ্যেই শ্রীরামপুর শহরের নানান উন্নতি ঘটিয়েছিল। শোনা যায়, তাঁরা নিজেরা বাণিজ্য করলেও এই শহরকে মনের মত করে সাজিয়েছিল। পরবর্তীকালে এই শহরের উন্নতিতে একই ধরনের ভূমিকা নিতে শুরু করে শ্রীরামপুরে বসবাসকারী কিছু প্রাচীন জমিদার পরিবার। যেমন ছিল গোস্বামী পরিবার।

১৮৪০ সালের কথা। আলীবর্দী খাঁ ছিলেন বাংলার মসনদে। এই সময় বর্ধমানের পাটুলিতে বাস করতেন বিশেষ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত শ্রী লক্ষ্মণ চক্রবর্তী। নদীয়ার শান্তিপুরের গোস্বামী বংশের পন্ডিত ভীম তর্কপঞ্চাননের কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয় লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর। পরবর্তীকালে লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর পুত্র  রামগোবিন্দ তাঁর মাতামহের কাছে থাকতে শুরু করেন এবং ‘গোস্বামী’ পদবী গ্রহণ করেছিলেন।

 

GoswamiPalace1

কথিত আছে একবার নাকি রাম গোবিন্দ গোস্বামী তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে নৌকো করে শান্তিপুর থেকে কলকাতার দিকে যাচ্ছিলেন। নৌকো শ্রীরামপুরের কাছে এলে রামগোবিন্দর স্ত্রীর হঠাৎ করেই প্রসববেদনা উপস্থিত হয়। নদীর তীরেই পুত্র সন্তানের জন্ম দেন রামগোবিন্দ গোস্বামীর স্ত্রী। এই সময়ে শ্রীরামপুর ছিল শেওড়াফুলির রাজাদের অধীনে। আবার শেওড়াফুলি ছিল পাটুলির রাজাদের কাছারিবাড়ি।

শেওড়াফুলির রাজ পরিবারের কাছে যখন এই খবর পৌঁছয় যে, পাটুলির শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতের পৌত্র শ্রীরামপুর অঞ্চলে জন্ম নিয়েছে, তৎকালীন রাজা মনোহর রায় ওই অঞ্চলের সম্পত্তি রামগোবিন্দকে দান করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু রামগোবিন্দ গোস্বামী ব্রাহ্মণ মানুষ। অন্তরে লোভের লেশমাত্র নেই, বিষয়-সম্পত্তির ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত। এদিকে রাজা মনোহর রায় নাছোড়বান্দা।
তাহলে উপায়?

ব্রাহ্মণ রাম গোবিন্দ তখন একটা কড়ির বিনিময়ে সেই সম্পত্তি শেওড়াফুলির রাজার থেকে কিনে নেন।  শ্রীরামপুরের রাজবাড়ী স্থাপনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল এই পাটুলির লক্ষ্মণ চক্রবর্তীর পরিবারের হাত ধরে।

রাম গোবিন্দ গোস্বামীর দুই পুত্র ছিল। রামগোপাল এবং রাধাকান্ত। এঁদের পুত্ররা মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিভিন্ন অঞ্চলের দেওয়ান ছিলেন। ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ পণ্য সামগ্রী ইংল্যান্ডের রপ্তানি হতো একসময়, তাঁর কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাম গোবিন্দ গোস্বামীর পৌত্ররা।

 

GoswamiPalace2

রাধাকান্ত গোস্বামীর ছোট ছেলে হরিনারায়ণের সুযোগ্য সন্তান ছিলেন রঘুরাম। অর্থ, প্রতিপত্তি এবং দক্ষতার ক্ষেত্রে বিশেষ সম্মান অর্জন করেছিলেন। তিনি কলকাতার বিখ্যাত জন পামার কোম্পানির অধীনে মুৎসুদ্দির কাজ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছিলেন।

১৮৪৫ সালে ড্যানিশ সরকার শ্রীরামপুরের উপনিবেশ বিক্রি করে দিতে চাইলে রঘুরাম গোস্বামী বারো লক্ষ টাকার বিনিময়ে তা কিনে নিতে চেয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তেরো লক্ষ টাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শ্রীরামপুর কিনে নিয়েছিল। এই রঘুরাম গোস্বামী তাঁদের পৈত্রিক বাড়ির কাছে নিজস্ব একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। রঘুরাম গোস্বামীর নাতি কিশোরীলাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৫৬ সালে।

জমিদারি পরিচালনায় দাদুর মত সুদক্ষ ছিলেন নাতি। পরবর্তীকালে কিশোরীলাল ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছিলেন। বাঙ্গালা গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্য হয়ে তিনি ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি বাঙ্গালা শাসন-পরিষদের প্রথম ভারতীয় সদস্য। দাদুর তৈরি প্রাসাদেই বসবাস করতেন কিশোরীলাল গোস্বামী। এই প্রাসাদই পরবর্তীকালে শ্রীরামপুর রাজবাড়ী হিসেবে পরিচিত হয়েছিল।

 

GoswamiPalace3

 

শ্রীরামপুর শহরের উন্নতির ক্ষেত্রে গোস্বামী পরিবারের নানা অবদান ছিল। এই পরিবারের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিভিন্ন স্কুল, ছাত্রাবাস এবং হাসপাতাল। এমনকি বর্তমানে শ্রীরামপুর পৌরসভা ভবনটিও গোস্বামী পরিবারের দান করা। এটি আগে কিশোরীলাল গোস্বামীর কাছারিবাড়ি ছিল। এই রাজবাড়ীতে দুর্গাপুজো হত। রামগোবিন্দ গোস্বামী প্রথমবার তাঁদের শ্রীরামপুরের বসতবাড়ির সংলগ্ন ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন।

পরবর্তীকালে রঘুরাম গোস্বামী তাঁর নিজের প্রাসাদেও দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন, পরে যাকে শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো নামে অভিহিত করা হত।

শ্রীরামপুর রাজবাড়ী সুন্দর, ঐতিহ্যবাহী নানা কারুকার্যে ভরা। বিভিন্ন অংশে বিদেশি ধারায় কারুকার্য করা হয়েছে। ঠাকুরদালানের ভেতরের অংশে মার্বেল পাথরের মেঝে আছে এবং দেওয়ালে পঙ্খের কারুকার্য করা রয়েছে। ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই রাজবাড়ীর খিলানে কান পাতলে আজও ইতিহাসের পদধ্বনি শোনা যায়। শ্রীরামপুরের দর্শনীয় স্থান হিসেবে এই রাজবাড়ীর নাম উল্লেখযোগ্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...