রাজবাড়ী পর্ব:২১

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু। তমলুক বা তাম্রলিপ্ত রাজবাড়ির অন্তরমহল। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে কয়েকজন ইংরেজ কর্মী। রাজবাড়ীর রানী নাকি তাঁদের ডেকেছেন। একে তো এক ‘মহিলার’ ডাকে আসতে হয়েছে। তার ওপর অপেক্ষা করতে হচ্ছে তার জন্য। রীতিমতো বিরক্ত ইংরেজরা সে সময়। অবশেষে অন্দরমহল থেকে বাইরে এলেন রানী কৃষ্ণপ্রিয়া।

''আমি ক্ষমাপ্রার্থী আপনাদের অপেক্ষা করানোয়''। নম্র ভাবে নিজের কথা জানালেও তাঁর পরের কথায় প্রমাদ গুণলেন ব্রিটিশরা। ''রাজবাড়ির সম্পত্তিতে কেবলমাত্র অধিকার থাকবে রাজার ও তাঁর প্রজাদের। এই সম্পত্তির কোন অংশই ব্রিটিশ সরকারকে তমলুক রাজবাড়ী থেকে দেওয়া হবে না।''

চেয়ারে বসে থাকা গোরা সাহেবরা তখন ক্ষেপে উঠেছে। 'সামান্য এক নারী' তাদের এইভাবে অপমান করছে। যেখানে অনেক রাজবাড়ীর সদস্যরা ব্রিটিশ আনুগত্য লাভের জন্য সব সময় নতমস্তকে থাকে, সেখানে এক সামান্য নারীর এত ঔদ্ধত্য! না একেবারেই এটা মেনে নেয়নি ব্রিটিশ সরকার। শুরু হয়েছিল লড়াই। রানী যে যুদ্ধের মনোভাব দেখিয়েছিলেন তাই আজন্মকাল ধরে লালন করেছে তমলুক রাজবাড়ী। তমলুক রাজবাড়ী এভাবেই বারবার ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করে এসেছে। তমলুক রাজবাড়ীর রানী কৃষ্ণপ্রিয়া প্রথমবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। তখন থেকেই এই রাজবাড়ির নাম যুক্ত হয় স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু। তমলুক রাজবাড়ী স্বদেশী আন্দোলনে তখন সক্রিয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সেই সময় রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি রীতিমতো সভা আয়োজন করেছিলেন। ‌ রাজবাড়ীর অন্দরে প্রায়ই শোনা যেত বন্দেমাতরম ধ্বনি। স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করতেন এই রাজ পরিবারের সদস্যরা। ‌ আন্দোলন করে বিদেশি দ্রব্য পোড়ানো হত রাজবাড়ীতে।

এই রাজবাড়ীর তরফ থেকে তমলুক শহরে প্রথম সবচেয়ে বড় সভা আয়োজন করা হয়। তমলুকের রাজপরিবারের কাহিনী পুরনো। প্রাচীন তাম্রলিপ্তের ময়ূরধ্বজ-তাম্রধ্বজ রাজারা মহাভারতের সমসাময়িক। তাম্রলিপ্ত বন্দর সে সময় বাণিজ্য নগরী ছিল। রূপনারায়ণ নদীর তীরে গড়ে ওঠা তাম্রলিপ্ত বন্দর ছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্য নগর। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই বন্দর ছিল বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় প্রকৃতির। রূপনারায়ণ নদী তার নাব্যতা হারাতে থাকে। ফলশ্রুতি হিসেবে ক্রমাগত অবক্ষয় হতে থাকে বন্দরের। তাম্রলিপ্ত নগরীও হারাতে থাকে তার জৌলুস।

Tamluk-Rajbari_01

বর্তমানে যে রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষটি রয়েছে ধরা হয় তা ময়ূরবংশীয় রাজাদের। এই রাজাদের রাজবাড়ী ও রাজ আঙিনা ছিল আট মাইল দীর্ঘ ও তেমনি প্রশস্ত। শক্তপোক্ত পাঁচিল দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। বর্তমানে এই রাজবাড়ীটি কৈবর্ত রাজাদের বলে ধরে নেওয়া হয়। রাজা আনন্দ নারায়ণ রায় অপুত্রক হওয়ায় রানী কৃষ্ণপ্রিয়া লক্ষীনারায়ণকে দত্তক নেন। পরবর্তীকালে লক্ষীনারায়ণকেও রাজা উপাধি দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান রাজবাড়িটি নাকি তাঁর হাতেই তৈরি।

এই রাজবাড়ির মূল ভবনটি একটি চতুষ্কোণ ক্ষেত্রকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। সারি সারি স্তম্ভ রয়েছে এখানে। মুঘল স্থাপত্য ধারাকে অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছিল এই রাজবাড়ী। ঐতিহাসিকরা বলেন মধ্যযুগের ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্য এটি। মূলত ইট আর চুন-সুরকির সঙ্গে লাল বেলেপাথর ব্যবহৃত হয়েছে। রাজবাড়ীর অধিকাংশই ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও যেটুকু চোখে দেখা যায় তা যে এককালে স্থাপত্যের দিক থেকে অভিনব ছিল সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ২০০৪ সালে এই রাজবাড়ীকে জাতীয় সৌধ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

তমলুক রাজবাড়ী বরাবরই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। রাজা সুরেন্দ্র নারায়ণ রায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে সত্যাগ্রহী দের থাকার জন্য রাজবাড়ির একটি অংশ তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি স্বদেশীদের সাহায্য করার জন্য সুরেন্দ্র নারায়ণ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের হাতে।

৯৩৮ সালের ১১ই এপ্রিল এই রাজবাড়ী সংলগ্ন বাগানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একটি জনসভার আয়োজন করে। ফলে ব্রিটিশ সরকার ক্ষুব্ধ হয়েছিল সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর।

ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ীটির এদিক ওদিকে শুধুই স্মৃতির পাহাড়। একটুকরো চলমান ইতিহাস যেন। রাজবাড়ীর চারপাশে আগাছা, জঙ্গল স্থায়ী আবাস গড়েছে। তবুও এই অঞ্চলে গেলে চোখ ফেরানো যায় না ইতিহাস থেকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...